দেবা ন জানন্তি কুতোঃ মানবা
দিলীপ চক্রবর্তী
সুজন প্লেনে উঠে নিজের সিটে বসল। লম্বা জার্নি, প্রায় দশ ঘন্টা প্লেনে থাকতে হবে। প্লেনে থাকার শারীরিক অস্বস্তির কথা একমাত্র তারাই জানে যারা বিমানে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। দীর্ঘ সময়ের উৎকণ্ঠা ওর মনে আরেকটা উত্তেজনা কাজ করছে। সেটা হল প্রায় বিশ বছর পরে দেশে যাচ্ছে। সেই বাবার মৃত্যুর পরে দেশে গিয়েছিল, পারলৌকিক ক্রিয়া কর্মের জন্য। তারপর আর যায় নি। মা বাবা না থাকলে দেশের প্রতি আগ্রহ অনেকেরই কমে যায়, সুজনে১রও সেটাই হয়েছিল, দেশের আকর্ষন কমে গিয়েছিল।
হঠাৎ বাবার মৃত্যুর পর দেশে আসার কথা মনে হল। বিশেষ করে বড়দার কথা। শ্রাদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ওদের বাড়ি ভাগের কথা উঠেছিল, কথাটা বড়দাই তুলেছিল। সুজন বিদেশে থাকে এ অজুহাতে সুজনকে বাড়ির অংশ দিতে চায় নি। বড়দা বলেছিল – তুই তো আর দেশে ফিরবি বলে মনে হয় না, তাই তোর অংশটা আমাদের দিয়ে দে। মেজদা সৃজনও বড়দার সাথেই সুর মিলিয়ে বলেছিল – বড়দা ঠিকই বলেছে, তোর অংশটা ছেড়ে দে। তা ছাড়া অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি হলে তার ভাগ তুই পাবি। আর এখানে বেড়াতে এলে তুই আমাদের কাছেই থাকবি। একটু পরে জিজ্ঞেস করেছিল – কিরে, দাদাদের কাছে থাকতে তোর কোন আপত্তি হবে না তো? দুই দাদার কথা শুনে সুজন অবাক হয়ে গিয়েছে।
সবে শ্রাদ্ধ শেষে হয়েছে গতকাল। ঘরে বাবার সিগারের গন্ধ এখনও চারিদিকে ঊড়ে বেড়াচ্ছে, তার মধ্যেই দুই দাদার প্রস্তাবে সুজন বিরক্ত হল, তবে মুখে কিছু বলল না। ভাবল বড়বৌদিকে জিজ্ঞেস করে সব জানবে, তারপর ওদের সাথে বাড়ি নিয়ে কথা বলবে। তবে এটা বুঝেছে – মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য সব কিছু করতে পারে, তখন লজ্জা বা দ্বিধার কোন অস্তিত্ব থাকে না, এমনকি ভাই বোনের জন্যও কোন স্থান থাকে না। পরদিন বৌদি বলেছিল – তোর দাদাদের কথা শুনে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। তুই এ প্রস্তাবে রাজী হ’স না, বিশেষ করে তোর দেওয়া টাকাতেই তো বাবা বাড়িটা সম্পুর্ন করতে পেরেছিলেন। এ কথাটা তোর দাদারা ভুলে গেল কি করে?
বৌদি, তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তুমিও কি বাড়ি নিয়ে দাদাদের
মতই ভেবেছ? সুজনের কথা শুনে বৌদি বলেছিল – তোর টাকায় বানানো অংশটা আমি তোর জন্যই রাখব, এতে তোর দাদা বা কারো কোন অধিকার নেই। বলে আঁচলে চোখ মুছে বলেছিল – সুজন, এখন তুই বিশ্রাম কর, পরে তোর সাথে আমি কথা বলব। বলে ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। এটাই হয়েছিল ওর সাথে আগের বার যখন দেশে এসেছিল। তবে এবার আলাদা কথা, এখন সুজনের কোন প্রত্যাশা নেই কারো কাছে। তা ছাড়া ওর জীবনের কাছে কিছু চাওয়ার নেই। ও নিজে একজন বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনীয়ার, কর্মক্ষেত্রে ওর সুনাম ও প্রতিপত্তির কথা কারিগরী জগতের সকলের কাছেই স্বীকৃতি পেয়েছে। আর্থিকভাবে অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত। সারা জীবন কাজ আর কাজই ছিল ওর জীবন, কখনও সংসার বা বিয়ের কথা মনে হয়নি, তা ছাড়া কে ই বা ওর কথা ভাববে। তবে হ্যাঁ, মোহর বৌদি অর্থাৎ বড়বৌদির কথা অবশ্য আলাদা, সব সময় চিঠিতে বিয়ের কথা লিখত, আর প্রতিবার সুজন লিখত – বৌদি, আমি এসব ভাবার সময় পাইনি, তা ছাড়া কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি, এটাই আমার ভালো লাগে, তিন ভাইএর একজন না হয় বিয়ে না ই করল। ওর কথা ভেবে মোহর কষ্ট পেত, ভাবত শাশুড়ী্র শেষ কথাটা হয়ত ও আর রাখতে পারবে না। মৃত্যুর কিছুদিন আগে শাশুড়ী ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলেছিলেন – বৌমা, সুজনের সাথে আমার আর হয়ত দেখা হবে না, তুমি ওকে একটু দেখে রেখো, ওর বিয়ে দিও একটা ভালো মেয়ের সাথে। ওর বিয়ে না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না । তারপর একটু দম নিয়ে শাশুড়ী বলেছিল – ছোটবেলা থেকেই সুজন বড় সরল আর দুই দাদাকে খুব বিশ্বাস করে, কিন্তু বড় ভাই দজন ওকে সব সব কিছুতেই ঠকাতো, সে জন্য সুজনের প্রতি আমার একটু নজর থাকত সব সময়, ওর দরদী মনের সুযোগ নিয়ে আমার জন্য সুজনের টাকাটা ওরা দুভাই মিলে কেমন আত্মসাৎ করে দিল, দেখলে তো? পারলে ওরা সুজনকে বাড়ি থেকেও বঞ্চিত করবে। তুমি দেখো – সুজন যেন ওর প্রাপ্য অংশ পায়। তোমার কাছে এটাই আমার অনুরোধ। মোহর শাশুরীর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলেছিল – মা, আপনি ভাববেন না, আমি সুজন দেশে এলেই ওর বিয়ে দিয়ে দেব সুন্দরী একটা মেয়ের সাথে। বৌমার কথা শুনে শাশুড়ী আস্বস্ত হয়ে বলেছিল – সেটাই কোর বৌমা। তার কিছুদিন পরে শ্বাশুড়ী প্রয়াত হলেন, অনুজও আর দেশে আসেনি, মোহর শাশুড়ীকে দেওয়া কথা রাখার আর কোন সুযোগ পায় নি। এখন সুজন এসেছে, মোহর শাশুড়ীকে দেওয়া কথা রক্ষার কথা ভাবছিল।
পিতা মাতা সর্বদা প্রতিটি সন্তানকে তাদের স্নেহ ভালবাসা সমানভাবে দিয়ে থাকে, তবে যে সন্তান দুর্বল, তার প্রতি হয়ত তাদের সাহায্যের হাত একটু বেশী থাকে, এটা পক্ষপাতিত্ব নয় বরং দুর্বলকে সবল করে তোলার প্রচেষ্টা মাত্র। মোহর ভাবল – এজন্যই তার শাশুড়ী সুজনের দায়িত্ব দিলেন বৌমাকে। তবে মোহর এটাও লক্ষ্য করেছে – সুজনের দুই দাদা সুজনের প্রতি উদাসীন। সুজনের প্রতি ওদের কোন আগ্রহই নেই। মোহর এটাও ভাবল – প্রতিটি সংসারেই দু এক জন থাকে এবং যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য কোন কিছুই করতে দ্বিধা করে না।
You are a wonderful writer. Each of lines depict practical experience in our life. Kudos
Comment by RP Chakravarty — January 17, 2025 @ 8:58 am