টুটুনের বন্ধু
সেবার টুটুন আর আমি দেশে যাচ্ছি। বড় দুই ছেলেকে সঙ্গে নিলাম না কারণ তারা তাদের বাবার সঙ্গে থাকতে পারবে। তাছাড়া তাদের সামারের ছুটিতে অনেক রকম প্রোগ্রাম থাকে। ছোট ছেলে টুটুনকে একা বাড়ীতে রাখা যায়না তাই আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম। রাত আটটায় প্লেন, পাঁচটার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। এনার তো সবেতেই তাড়াহূড়ো, সবসময়েই তাঁর প্লেন ফেল হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক ছোট ছেলেকে নিয়ে যেতে হবে এতটা রাস্তা তাই আর কোনও বাকবিতণ্ডার মধ্যে ঢুকলাম না।
আমরা দুজন ভেতরে ঢুকে যাবার আগে পর্য্যন্ত টুটুন তার বাবার হাত ধরেছিলো, এখন হাত ছেড়ে যেতে হবে বলে চোখে তার জল এসে গেল। তবু বাবাকে হামি দিয়ে সে শান্তভাবেই ভেতরে ঢুকল। যথাসময়ে প্লেনের ভিতরে ঢুকে নিজেদের সীটে বসলাম। অনেক লম্বা রাস্তা কিন্তু টুটুন সঙ্গে থাকাতে আমাদের সময়টা ভালোভাবেই কেটে গেল। পাশে একটা বদ্ লোক বসেছিলো, টুটুনের সঙ্গে খুব ভাব জমাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে, বাংলাতে কথা বলছে দেখে টুটুনের খুব ভালো লেগে গেছে। বাপের বয়সী একটা লোক পেয়ে টুটুন বাপের সাময়িক অনুপস্থিতির ব্যাপারটা ভুলে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি লোকটার নজর আমার দিকে।বদ্ লোকদের উদ্দেশ্য বুঝতে বেশী দেরী লাগেনা। যাইহোক একসময়ে টুটুন ঘুমিয়ে পড়ল। লোকটা আমার সঙ্গে ভাব জমাতে বিফল মনোরথ হয়ে মুভি দেখায় মনোযোগ দিল। প্লেনে লম্বা জার্ণি করে আমরা কলকাতা পৌঁছালাম, বাড়ী গিয়ে দুজনে অল্পকিছু খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম। দুতিন দিন চলল আমাদের জেটল্যাগ। তারপরই বাড়ীর লোকদের ব্যাস্ত রাখায় টুটুন মনোযোগ দিল।
সবাই খুব আদর করছে, কোলে নিচ্ছে, টুটুনের খুব ভালো লাগছে। বয়স ৬ বছর হলে কি হবে, এই টিংটিঙ্গে রোগা। কোলে নিতে কারোরই কোনও অসুবিধা নেই। সকলের একটাই প্রশ্ন, ওদেশে থেকে এত ভালো আবহাওয়াতে থেকে এত রোগা কেন? সে যে কিছুই খেতে চায়না কি করে বোঝাবো। এদিকে এখানে তো ভাত মাছের ঝোল দিব্যি গপ্ গপ্ করে খেয়ে ফেলছে। বাড়ীতে ছোট দাদুর সাথে খুব ভাব হয়েছে। ছোট দাদু হচ্ছে টুটুনের বাবার ছোটকাকা। উনি হচ্ছেন বামন, মানে প্রতিবন্দী, কিন্তু বাড়ীর সকলেরই খুবই প্রিয় মানুষ।আমাদের ঘুম ভাঙ্গে রোজ তাঁর বাথরুমে মুখ ধোওয়ার বিরাট গলা খেঁকুরির আওয়াজ শুনে।
এই ছোটদাদু টুটুনের খুব প্রিয় বন্ধু হয়ে গেল। এক হচ্ছে ছোটদাদুর আর টুটুনে শারিরীক উচ্চতা সমান, টুটুন দাদুর কাঁধে হাত রেখেই চলতে পারে। তার ওপর দাদু সকাল বেলা থেকেই বলতে থাকে, “যা ইস্কুলে যা, ফরস্ না ক্যান, ফরতে বস ফরতে বস”। প্রথম দিকে টুটুন ছোটদাদুর বাঙ্গাল ভাষা বুঝতে পারত না, কিন্তু দুচারদিনের মধ্যেই দাদু আর টুটুন বেশ ভালোই কথোপকথনে রপ্ত হয়ে গেল, একজন বাঙ্গাল ভাষা বলে আর একজন ইংরাজী।
বাড়ীতে অনেক গাছপালা আছে, সেগুলির দেখাশুনা ছোটদাদুই করে থাকেন। অনেক পেয়ারা গাছ আছে, পাড়ার ছেলেপিলেরা সুযোগ পেলেই গাছে উঠে পেয়ারা খায় কিংবা চুরি করে নিয়ে যায়। দাদুর একটা ছোট লাঠি আছে, দাদু সেটা হাতে নিয়ে হাঁক দিয়ে ছেলেগুলিকে তাড়া করেন। টুটুন একটা খেলা পেয়ে গেল, দাদুর হাত থেকে বেঁটে লাঠিটা নিজের হাতে নিয়ে দাদুকে বলে দিল ইংরাজীতে যে ঐ ছেলেগুলোকে সে সায়েস্তা করে দেবে। দুজনে মিলে বাইরের বারান্দায় পাহাড়ায় বসে গেল। ছেলেগুলো গেটের কাছে আসলেই টুটুন লাঠি হাতে ইংরাজিতে বকাবকি করতে করতে ধাওয়া করত গেট অবধি কিন্তু গেটের বাইরে কখনই যেতনা কারণ সে জানত রিণি বাইরে যাওয়ার পারমিশন তাকে দেয়নি।
ওমা, পরেরদিন রিণি দেখে পাড়ার ছেলেগুলি সব বাড়ীর ভেতরের মাঠে বল খেলছে আর টুটুন তাদের লীডার। ছোটদাদুও চুপ করে বারান্দায় বসে তাদের খেলা দেখছে। টুটন তাদের সঙ্গে ইংরাজীতে নির্দেশ দিচ্ছে আর তারাও ঠিক্ ঠাক্ সেইমতোই খেলা করছে। ভাষা হলো উন্মুক্ত, কখনই বাচ্চাদের খেলার প্রতিবন্দক হতে পারেনা।
দুদিন পরে আমরা জায়েরা আর বাড়ীর বড় মেয়েরা মিলে বেলুড় মঠে গেলাম। গাড়ী ভর্তি মেয়ে একমাত্র টুটুন আর ড্রাইভার পুরুষ। টুটুন তো আনন্দে আত্মহারা, ওর খুশীর সীমা নেই। আমার জায়েরা লুচি তরকারী করে নিয়ে গিয়েছিলো, টুটুনকে দেবনা দেবনা করেও একটা মিষ্টি দিয়ে দিলাম, সবাই বলল কিছু হবেনা ভাল দোকান থেকে মিষ্টি কেনা হয়েছে। টুটুন মিষ্টি খায়না এমনিতে, মুখে দিয়েই ফেলে দিল। আমি সঙ্গে করে ক্যাডবেরী নিয়ে গিয়েছিলাম। সেইগুলো টুটুন আর মেয়েদের দিলাম। তারপর আমরা রামকৃষ্ণদেব স্বামীজীর মুর্তিকে প্রণাম করবার জন্য ভেতরে যাব ঠিক করছি এমন সময়ে একটি ১১/১২ বছরের ছেলে একটা ছোট বাঁশে লাগানো বেলুনের ঝুমঝুমি বিক্রি করতে এল। অমনি টুটুনের বায়না শুরু হয়ে গেল ঐটা কিনে দিতে হবে। দাম হচ্ছে আড়াই টাকা। আমার জায়েরা ছেলেটার সঙ্গে দরাদরি করার চেষ্টা করছিল, আমি বাধা দিলাম। টুটুন ওসব দেখতে অভ্যস্ত নয়। আমার কাছে খুচরো আড়াইটাকা ছিলনা। ছেলেটাকে বললাম তুমি সব টাকাটাই রেখে দাও। ছেলেটা রাজী হলনা সে আমাকে আড়াই টাকা ফেরৎ দিল। টুটন আর আমি ছেলেটার সততা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বিশেষ করে টুটুন, সে ভেতরে যেতে রাজী হলনা। আমাকে বলল ‘মামি তুমি যাও আমি রহিমের সঙ্গে থাকি’। ছেলেটা মুসলিম, তার নামটা টুটুনের জানা হয়ে গেছে। আমি সবাইকে বললাম ভেতরে ঘুরে আসতে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ওদের সঙ্গে। তার সঙ্গে দুমিনিটের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল টুটুনের অথচ কেউ কারোর ভাষা জানেনা। দেখি টুটুন রহিমের বেলুন বেচতে সাহায্য করছে।
পরের দিন ড্রাইভার আমাদেরকে আমার বাপের বাড়ীতে পৌঁছতে গেল, সঙ্গে আমার জ্যাঠাতুতো ননদ গেলেন।বিকেলবেলা আমার ননদ চলে গেলেন ড্রাইভারের সঙ্গে। সেখানে টুটুন তার মাসতুতো দাদাকে পেয়ে খুব খুশী, সে তার নিজের দাদাদেরই বয়সী। সারাক্ষন তার সঙ্গে এবং পেছন পেছন ঘুরতে লাগলো। আমার মার সঙ্গে টুটুনের ভাব বেশী কিন্তু আমার বাবাকে সে পছন্দ করলনা। বাবা পুলিশে কাজ করেছেন তাই তার মেজাজ একটু কড়া। টুটুন বাবকে পরিস্কার বলে দিল সে তাকে ভালবাসে না, তার যে দাদু আমাদের সঙ্গে থাকে মানে টুটুনের ঠাকুর্দা তাকেই সে বেশী ভালবাসে। টুটুনের ঠাকুর্দা কিঞ্চিৎ নিরীহ প্রকৃতির আর মুখবুজে নাতির সব অত্যাচার সহ্য করেন তাই তিনি টুটুনের বেশী প্রিয়।
আমাদের ফিরে আসবার সময় এগিয়ে আসছে ক্রমশ, আমার যতই মন খারাপ হচ্ছে টুটুন ততই খুশী কারণ ও তার দাদাদের, বাবা, দাদু যাকে সে বেশী ভালোবাসে এবং তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আবার দেখতে পাবে। কলকাতায় ফিরে শুনলাম আমার বড় জায়ের মেয়ের বাচ্চা ছেলের মুখেভাত। ওখানে গিয়েই উঠলাম। মেয়ে জামাই কদিন পরে আসবে মুখেভাতের দুদিন আগে। এদিকে জায়ের বাড়ীতে ফাইফরমাস খাটবার একটা ১১/১২ বছরের ছেলে রয়েছে, তার নাম সুনীল। ব্যাস, টুটুনের বন্ধু জুটে গেল আবার। সারাক্ষন সুনীলকে ডাকাডাকি, ইংরাজীতে নির্দেশ দেওয়া চলছে। কিন্তু সুনীল তো এবাড়ীতে কাজ করে, তার তো টুটনের সঙ্গে খেলাধূলো করলে চলবেনা। টুটুনকে কেউ কিছু বলতে পারছেনা কিন্তু সুনীলে ওপর বকুনির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আমি টুটুনকে বুঝিয়ে বললাম সুনীলের কাজ করার সময় ওকে খেলা করতে না ডাকতে। টুটুন তো বুঝতেই পারেনা বাড়ীতে এত লোক থাকতে সুনীলকে এত কাজ করতে হবে কেন? সবচাইতে কষ্টকর ব্যাপার ঘটল মুখেভাতের আগের দিন সুনীলকে বলা হল বাড়ী চলে যেতে কারণ মুখেভাতের জন্য অন্য লোক ঠিক করা হয়েছে তারাই সব কাজ করবে। টুটুন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সুনীলকে দেখতে না পেয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। সবাই বলছে সুনীল পরে আসবে। ক্রমে মুখেভাতের সময় হয়ে এল, আমার জা টুটুনের জন্য গরদের পাজামা পাঞ্জাবী কিনেছেন। সেটা পরে টুটুনও জায়ের বড় ছেলের সঙ্গে ভাগ্নাকে ভাত খাওয়াবে। কিন্তু তার মনের মধ্যে সুনীল বসে রয়েছে।
অনেক বেলা গেল, সব কাজ শেষ হলো সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। টুটুন আমাকে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো সুনীলকে নিয়ে আসার জন্য। আমি তো জানিনা সে কোথায় থাকে। টুটন সকলকে জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছে, ওর ধারনা আমাদের ড্রাইভার নিশ্চয় তার বাড়ী চেনে। কেউ টুটুনের কথা শুনলনা। রাত্রে বিছানায় শুয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে তার কান্না সুনীলে জন্য আমার বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো। এত হৈ চৈ এত আড়ম্বর কিসের জন্যে, আমার নিস্পাপ সন্তানের অবোধ শিশু মনকে যন্ত্রনা দেওয়ার জন্য? আজ পর্্য্যন্ত সেই ঘটনা আমি ভূলতে পারিনি।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment