কোথায় হারিয়ে গেল সেই রবিবারের ছুটির দিনগুলো
সত্যিতো কোথায় হারিয়ে গেল ছোটোবেলার রবিবারের সেই ছুটির দিনগুলো ? শুধু ছোটোবেলাই বলি কেন, কৈশোরে ছাত্রজীবনে, বড় হয়ে চাকরীজীবনে , সংসার সমরাঙ্গনে, চাকরীজীবন থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্য্যন্ত রবিবারের সেই ছুটির দিনগুলোর একটা আলাদাই মেজাজ ছিল ! অবসর জীবনে অবশ্যি প্রতিদিনইতো ছুটির দিন – প্রতিদিনইতো রবিবার ! কিন্তু আগেকার দিনের সেই মেজাজ, সেই আনন্দতো অনেকটাই এখন আর খুঁজে পাইনা; হারিয়ে হয়ত যায়নি পুরপুরি, ধরনটা গেছে পালটে ! দৈনন্দিন টানাপড়েনে জীবনের ছোট-বড় সব আনন্দগুলো উপোভগ করা হোয়ে ওঠে না, আকাশের তারাদের মত দিনের আলোতে থাকে লুকিয়ে । অবসর জীবনে, ক্লান্তি-কষ্টের সময়গুলোতে, মনে পড়ে ফেলে আসা সেইসব আনন্দের মুহুর্তগুলো, রাতের অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলে ওঠে তারাদের মত । তা হারিয়ে যাওয়া রবিবারের ছুটির দিনই হোক না কেন !
সকালবেলা বেশ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা আর ঘুরিমুরি, সবকিছুতেই আলসেমি আর কুঁরেমি । সকালের জমাটি জলখাবার – ফুলকো লুচি আর আলুর সাদা তরকারি, অথবা ময়দার পরটা আর বোঁদে, নয়তোবা কলা-আম-নারকেলকোঁরা-চিঁড়ে-মাখা, মুড়ি-ঝোলাগুড়-নারকেলের নাড়ু , অথবা পারার দোকান থেকে আনা গরম গরম কচুরি-আলুরদম বা সিঙ্গারা আর জিলেপি ! সবাই মিলে হৈ হৈ করে একসঙ্গে বাড়ির লম্বা বারান্দায় বসে রবিবারের ঐসব জলখাবার খাবার আনন্দটাই ছিল অন্য; গল্প, খুনটুসি, মজার মজার সব কথা …… কোথায় যেন সেই আনন্দ হারিয়ে গেল, এখন আর খুঁজে পাই না । ছোটবেলায় জলখাবার খেয়েই খেলতে ছোটা আর খেলার শেষে পুকুরে সাতার । বড় হয়ে থলে হাতে বাজার, রবিবারে সেওতো ছিল এক বিশাল কান্ড ! দুপুরের খাওয়াটাও ছিল স্পেশাল – ভাত আর গরগরা মাংসের ঝোল – আলু আর ঝোল বেশী, মাংস কম অথবা ডিমের ঝোল – বড়দের গোটা, ছোটদের হাফ ! তারপর দুপুরবেলা রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনতে শুনতে মুখ হাঁ করে ভাত-ঘুম, সে যে ছিল কী অভাবনীয় সুখ ! বিকেলে আবার খেলা, সন্ধ্যাকরে বাড়ী ফেরা – রবিবারে বাবার সময়ের কড়াকড়ির নিয়ম একটু শিথিল হতো; সন্ধায় রেডিওতে বাংলা নাটক, রেডিও-সিলোনে আমিন সাহানি ও বিনাকা গীতমালা (কলেজ হস্টেলে, বাড়ীতে ঐসব গান শোনা সম্ভব ছিল না ); রবিবারের ছুটি ফুরিয়ে যাচ্ছে একথা ভাবতে ভাবতে গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরা । এমনি করেই কেটে যেত রবিবারের আনন্দের সব ছুটির দিনগুলো ।
আজকের এই অবসর জীবনে রবিবারের সেইসব ছুটির দিনগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে ঠিকিই, কিন্তু হারায়নি ছুটির আনন্দ; শুধু পালটে গেছে আনন্দের উপকরনগুলো ! এখনতো সব দিনই রবিবার, স্কুল-কলেজ-ফ্যাক্টারি-অফিস-চাকরী থেকে ছুটি, কিন্তু ছুটি নিইনি জীবন থেকে । এখনও আছে দৈনন্দিন ব্যস্ততা, বিশেষকরে আমাদের নাতিবাবুকে
আর নিজেদের নিয়ে – সকাল ছটা থেকে রাত এগারোটা পর্য্যন্ত নিয়মকরে বিভিন্ন কাজের মধ্যে সময় কেটে যায় সোম থেকে শনি । রবিবার আমাদের ছুটি – এই দিনটা আমাদের (আমার ও আমার স্ত্রীর) একান্ত আপনার, শুধু আমাদের দুজনের । ঐদিন এখনো একটু দেরী করে ঘুম থেকে উঠি । সকালের জলখাবার বানানোর দায়িত্বটা এখন আমার, তাই বিভিন্ন রকম এক্সপেরিমেন্ট চলতেই থাকে – ডিম পাউরুটি দিয়ে ফ্রেঞ্চ টোষ্ট/ গ্রীল, অমলেটের টুকরো দিয়ে ভেজিটেবল চাউমিন / পাস্তা, পোহা, উপমা অথবা ইডলি-ধোসা । আগের তুলনায় খাবারগুলো সব পালটে গেছে – বাঙালীর চিরাচরিত খাবার ছেড়ে অন্তত এই ব্যাপারে এখন আমরা অনেক বেশী ভারাতীয় । খাবারের স্বাদ যেমন পাল্টিয়েছে, তেমনই পাল্টিয়েছে সবাই মিলে হৈ হৈ করে খাওয়ার সেই আনন্দ ! এখন আমরা দুজনে মিলে টিভিতে গান শুনতে শুনতে ব্রেকফাষ্ট করি, গল্প করি – আগেকার দিনের হৈ হৈ করা আনন্দের জায়গায় এখন এসেছে প্রাশান্তির খুশী !
সময়ের স্রোতে এমনি করেই রবিবারের ছুটির দিনের মত হারিয়ে গেছে কত কিছু, পাল্টে গেছে আরও কত কি! সাত দশকের এই জীবনে কতইতো পরিবর্তন দেখলাম – আমার আগের প্রজন্মের কেউ এতসব পরিবর্তন দেখেনি, আর আমার মনে হয় না আগামী প্রজন্মেরও কেউ এত কিছু পরিবর্তন দেখবার সুযোগ পাবে ! অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকি এই পরিবর্তনের খেলা । পরিবর্তনইতো প্রগতির মূল মন্ত্র আর এই প্রগতির নামইতো সভ্যতা ! এই প্রগতির পথে চলতে চলতে আমরা কতকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে চলি, পুরোনোকে পাল্টে নতুনকে বসাই আমাদের জীবনের সবকিছুতে – বাসস্থান, পরিবেশ, পরিধান, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, সংগীত, বিনোদন, খবরের আদান-প্রদান, এমনকি পারশপরিক সর্ম্পক্যও ! এই পরিবর্তনের কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরন নিচে দেবার চেষ্টা করলাম ।
বাসস্থান ও পরিবেশ : গ্রাম – ছোট শহর, নদী – নালা – খাল – দিঘী – পুকুর, বিস্তির্ন খোলা মাঠ – উন্মুক্ত আকাশ –মুক্ত বাতাস, গাছপালা –জঙ্গল – বাগান – ফুল –ফল, গরু –ছাগল –হাঁস –সাপ –ব্যাঙ –পাখি, মাটির / ইটের বাড়ি –খড়ের / টালির / টিনের চাল – বিরাট বড় আঙ্গিনা, – খাটা পায়খানা – কাঁচা পথ – কাঠ / কয়লার উনুন – কেরসিন লম্ফ / হারিকেন, তারায় ভরা রাতের আকাশ, কুকুর / শিয়ালের ডাক, সহজ সরল মানুষের দল ….থেকে এখন গাড়ি আর ফ্যাকটারির ধোঁয়ায় দম বন্ধ করা শহরের দুষিত পরিবেশ, কংক্রিটের জঙ্গল – ছোট্ট ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়ি – সংকির্ন মন – বন্ধ মনের দরজা – গরীব লোকেদের জন্য বস্তি, বাড়িতে যদিও সবরকমের আধুনিক উপকরন – ফ্রিজ – টিভি – সোফা – কুলার – এসি – গ্যাস – মাইক্র ওভেন ইত্যাদি, অসংখ্য গাড়ি – শব্দ – দূষন, সর্বদা ব্যস্ত মানুষের ভিড়, ভিড় স্বার্থাণেষী মানুষের, লড়াই করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম … যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র !
পরিধান : ইজের – গেঞ্জী – লুংঙ্গি – ফতুয়া – পাজামা – পাঞ্জাবী – ধুতি – আন্ডার ওয়ার – হাফসার্ট – হাতা গোটানো ফুল সার্ট – চটি – কাবলি স্যান্ডেল – বুট – পোর্টফোলিয়ো ব্যাগ ….থেকে এখন বারমুডা –হাফ প্যান্ট – ব্রিফ -ফুলপ্যান্ট – জিন্স – টিসার্ট – জ্যেকেট – কোট – প্যান্ট – টাই – বুট – স্পোর্ট সু – ফ্লোটারস – ব্যকপ্যক; মেয়েদের
বেলাতেও সেই রকম শাড়ি–সায়া -ব্লাউজ থেকে ফ্রক – লেংগা – সালাওার –কামিজ – জিন্স – লেগিং- লোপাজো –হাফ প্যান্ট – ফুলপ্যান্ট – জিন্স – টপ – নাইটি -আরও কত কি!
খাওয়া-দাওয়া : নারকেল – আম – নলেন গুড় দিয়ে মাখা মুড়ি – খৈ – চিড়ে, লুচি – আলুর সাদা তরকারি, গরম গরম ভাতে ঘি – আলুসিদ্ধ – কাঁচালঙ্গা, শুকতোনি – নিম বেগুন, পাতলা মুসরির ডাল – সোনা মুগ – কলাইডাল, পোস্ত –পাঁচমিশেলি তরকারি – পটলের দোরমা – এ্যচরের / মোচার ঘন্ট, ভাঁপা ইলিশ – চিংড়ির মালাইকারি – আঁড় সরষে – টেংরার ছাল – রুইয়ের কালিয়া – দইমাছ – চুনো মাছের চচ্চরি, ডিম কশা – গরগরা মাংসের ছোল – কশা মাংস, আমের / আনারসের / আলু বোখরার / কুলের চাটনি, দৈ – মিষ্টি – পিঠে – পুলি –পায়েস, মা-ঠাকুমাদের হাতে ভালবেসে বাড়িতে বানানো বিভিন্ন রকমের মুখোরোচক ও উপাদেয় খাবারের সংম্ভার………. থেকে এখন বাড়ির খাবারের চেয়ে বাইরের খাবারই বেশী, মুগলাই – পাঞ্জাবি – সাউথ ইন্ডিয়ান – চাইনিজ – থাই – কন্টিনেনটাল – ইট্যালিয়ান – আমেরিকান ………বাড়িতে রান্নার সব রকমের আধুনিক সরঞ্জাম থাকলেও গৃহকর্তীর রান্নার সময় নেই, তাই রাঁধুনীর হাতের বা নিজে কোনরকমে কাজ চালিয়ে নেওয়া খাবার আর উইক এন্ডে বাইরে রেসটোরেন্টে ভালমন্দ খাওয়া !
খেলাধুলা : লাট্টু –ঘুড়ি-লাটাই – ডাংঙ্গগুলি – মার্বেল – বুড়ি ছোওয়া – উবু-ইশ-বিশ – কুমির ডাঙ্গা – কানামাছি – চোর পুলিস – দারিয়াবান্ধা –পিট্টু – রুমাল চোর – পুকুরে সাতার – পাড়ার খেলার মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট –লুডো – বাগ বন্দী – চাইনিজ চেকার – তাস – দাবা ……… থেকে এখন খেলাধুলো করার জায়গাবিহীন ফ্ল্যাট বাড়ী – শৈশবকে হারিয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে আবধ্য ভিডিও গেমে মত্ত সব ছেলে মেয়েরা ! অবশ্যি সাধন থাকলে ক্লাবে অথবা স্পোর্ট কমপ্লেক্সে পয়সা দিয়ে সব রকম খেলারই সুযোগ আছে – ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, টেবিল-টেনিস, বাসকেট বল,স্কোয়াস, বিলিয়ার্ড, গল্ফ, সাতার ইত্যাদি । আর সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে যোগ ব্যয়ামের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, জগিং-সাইকিলিং ট্র্যাক, জিমন্যাসিয়াম !
যোগাযোগের সাধন : পোষ্ট কার্ড – ইনল্য্যান্ড – খামে ভরা হাতে লেখা চিঠি – টেলিগ্রাম – টেলিপ্রিনটার – ফ্যাক্স – ল্যান্ড লাইন টেলিফোন ………থেকে এখন মোবাইল – email – facebook -WhatsApp- tweeter-messenger ……
সম্পর্কের নাম : ঠাকুরদা – ঠাকুমা – দাদু – দিদিমা – মা – বাবা – শ্বশুর – শ্বাশুরি – জ্যেঠু – জ্যেঠীমা – কাকু – কাকিমা – মাসি – মেশো – পিসি – পিসে – মামা – মামী –ভাগ্নে – ভাগ্নী – ননদ – নন্দাই – জামাইবাবু – ঠাকুরপো – বৌদি – দাদা – দিদি – শালা – শালী – ভাইপো – ভাইঝি – ছোটদের ডাকনাম ইত্যাদিতে আগে ‘বড় / মেজ / সেজ / ন / রাঙা / ফুল / ছোড়’ যোগ করে একাধিক সম্পর্ককে শনাক্ত করা হত, কারন আগে পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছিল অনেক ; আর আজ একান্নবর্তী পরিবারের বদলে ‘স্বামী-স্ত্রী-একটি সন্তানের’ একক সংসারে বেশীর ভাগ নামই হারিয়ে গেছে এবং অল্প সংখ্যক
নামেই ডাকার প্রয়োজন মিটে যায় যেমন ড্যাডি/বাপি/বাপ্পা – মাম্মি/মাম্মা/মামনি – আংকেল – আন্টি …………..!
সম্পর্কের বন্ধন : আগেকার দিনে বেশীর ভাগ সম্পর্কের বন্ধনই ছিল আজীবন, ভাঙ্গা জিনিসকে জোড়া দিয়ে কাজ চালাবার মানসিকতায় কোন সম্পর্ককে সহজে ভেঙ্গে যেতে দেওয়া হত না, দূঃখ-সুখে মানিয়ে নেওয়া হত সব রকম পরিস্থিতিতে ……… আর এখন কোন সম্পর্কই অটুট নয়, সহিয়ষ্ণুতার অভাবে ও আরও কিছু ভাল পাবার আশায় অনেক সম্পর্কই ভেঙ্গে যায় !
অতিথি : আগে না ছিল দূরভাষ, তাই না কোনও আগাম খবর; না ছিল কলিং বেল, হঠাৎ করে কড়া নাড়ার শব্দে ‘কে?’র উত্তরে ‘আমি’র গলার স্বরে বুঝতে পারতাম বড় মামা না ছোট পিসি বা মেজ মাসি ………; দরজার খিল খুলে একরাশ খুশীর হাওয়া, মা’র গলায় আনন্দের সুর – ও মা বড়’ দা……আয় আয়; কোন প্রশ্ন নয় ‘হঠাৎ করে?’ বা ‘একটা খবর দিলেও তো পারতি’ ইত্যাদি; তখন ভাবনা ছিল ‘তিথি না মেনে যে আসে সেই তো অতিথি’! তার জন্য বিশেষ কোন আয়োজনের প্রয়োজন ছিল না; অতিথির আগমনই ছিল বিশেষ; কেউ বাড়িতে আসলে সে চা খাবে বা ভাত খেয়ে যাবে কি না জিজ্ঞাসা করা হত না – ধরেই নেওয়া হত সে খাবে; সম্প্যর্ক ছিল অন্তরঙ্গ – অতিথি এলে বাড়িতে আনন্দের হাট বসতো । আর সে বা তারা চলে গেলে সবার মনে দুঃখে ভরে যেত ……সেখান থেকে এখন আর আজ আমরা কেউ অ-তিথি নই, সবাইকে তিথি মেনেই কারুর বাড়ি যেতে হয় ! প্রথমে ভাবতে হবে ‘ওদের বাড়ি যাওয়া এখন উচিত কি না’, ফোন করে আগে জানতে হবে তাদের কর্মব্যস্ত জীবনে কখন তারা ‘ফ্রি’ আছে, আমাদের উপস্থিতিতে তাদের কোন অসুবিধা হবে কি না……ইত্যাদি ; তারপর নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে তাদের বাড়ি পৌছে নির্দিষ্ট সময়টুকু কাটিয়ে চলে এস; ‘weekend party’, ‘get-together on special occasions’ আজকের দিনের কারুর বাড়িতে যাতায়াতের ছাড়পত্র !
বিয়ে বাড়ির নেমতন্ন : বাড়ির ছাত জুড়ে বাঁশ-ত্রেপল দিয়ে প্যান্ডাল, তারই এক কোনে চট দিয়ে ঘেরা রান্নার জায়গা, গোবর মাঠি-ইট দিয়ে দুটো কয়লার উনুনে গনগনে আঁচে বিরাট বড় লোহার কড়াইয়ে উড়ে ঠাকুরদের রান্নার ব্যবস্থা, ফুল ও তোরন দিয়ে সাজান গেট, গেট পেরিয়েই লাল-সাদা কাপড়ের সামিয়ানায় হলুদ রংয়ের ছোট ছোট ফোলডিং চেয়ার – খাবার আগে অতিথিদের বসার জায়গা, তাদের আপ্যায়নের জন্য করজোরে বাড়ির বয়স্কজন, ছাতে খাবার জায়গা – ফোলডিং টেবিলের ওপর জলের ছিটে দিয়ে পাতা রোলের কাগজ, কলাপাতা – কোনে মাটির খুড়ি ও লেবুর টুকরো, জল দেওয়ার জন্য বাড়ির ছোট ছেলেমেয়ে আর পরিবেশনের জন্য পাড়ার দাদারা, খাওয়া শুরু হলে ঝড়ের বেগে এসে গেল বেগুন ভাজা – ছোলার ডাল – লুচি – ফিস ফ্রাই – ভাত – পোনা মাছের কালিয়া – ভেটকির পাতরি – পোলাউ – মাংস – দৈ – মিষ্টি – শেষে হাতে একটা মিষ্টি পান, এরই মধ্যে বয়স্কদের আওয়াজ ‘আরে এখানে আরও দুটো লুচি দে, আরেকটা মাছ, এদিকে রসগোল্লা নিয়ে আয় ইত্যাদি’ আর বাড়ির কোন কর্তাব্যক্তির প্রত্যেকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা ‘পেট ভরে খেয়েছেন তো?’…..সেখান থেকে এখন বিয়ের সবকিছুই নিজেদের বাড়ির বাইরে – বিয়ের জন্য বিশেষ বাড়িতে, ব্যাঙ্কোয়েট হলে, ফার্ম হাউসে অথবা কোন হোটেলে; ডেকোরেটারদের দিয়ে চোখ ধাঁধানো
আলো ঝলমল সাজ সজ্যা, ক্যাটেরার দিয়ে দেশ – বিদেশের নানান রকমের খাবার ও পানীয় বিভিন্ন টেবিলে সাজান, তোমার ইচ্ছামত যা খুশী -যত খুশী খাও – কেউ কিছু বলার নেই , ‘পেট ভরে খেয়েছেন তো?’ জিজ্ঞাসা করারও কেউ নেই । বিয়ে বাড়ি গেলে – চেনা পরিচিতদের সাথে একটু কথা বার্তা বললে, হাসি ঠাট্টা করলে, খেলে আর চলে এলে – অনেক সময় হয়ত বর বা বৌয়ের সাথে দেখাও হল না ! এরই মধ্যে সময় করে গিফ্টটা (বেশীর ভাগ সময় খামে ভরা টাকা) ঠিক মানুষের কাছে পৌছে দিলে !
এমনি করেই সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে প্রগতির পদক্ষেপে আর সেই সঙ্গে কনজুয়ারিজিমের ধাক্কায় কোনকিছুই আজ বেশী দিন টেঁকে না – না জিনিষ পত্র, না কোন সম্পর্ক্য, তা বিবাহই হোক না কেন ! মানুষের আয়ু ধীরে ধীরে বেড়ে চললেও আর সবকিছুরই আয়ুস্কাল কমে আসছে ! আগে একটা গাড়ি, ফ্রিজ বা রেডিও কিনলে মোটামুটি সারাটা জীবন কেটে যেত । কিছু খারাপ হলে সেটাকে ঠিক করে আবার ব্যবহার করা হত । এখন কিছু খারাপ হলে সেটাকে ফেলে দিয়ে নতুন একটা কেনা হয় – পুরোনো জিনিস বর্জনের মধ্যেই আধুনিকতা ! তাই সবকিছুই কয়েক বছর পর পর পালটাতে পারলেই ভাল – টেকনিকি প্রগতি আর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারনে আমরা আজ সহজে পুরোনো জিনিষ পাল্টে নতুন কিছু কিনতে পারি । কিন্তু এই পাল্টানোর মানসিকতা আমাদের সম্পর্ক্যগুলোতেও চাপের সৃষ্টি করছে – বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব ……… জীবনে এগিয়ে যাবার তাগিদে সব সম্পর্ক্যই যেন আমরা হারিয়ে ফেলি বা পাল্টে ফেলতে চাই । তাই বোধহয় আমরা আজ এত একা !
রবিবারের ছুটির দিনের মত পাল্টে যাচ্ছে সব, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই । এই পরিবর্তনের অনেকটাই আমাদের হাতের বাইরে । তারই সাথে যথা সম্মব নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাই শুধু আমাদের নিয়ন্ত্রণে । তাই এই পরিবর্তনের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিয়ে এগিয়ে চলাই হল জীবন ।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment