ভালো ছেলেদের কথা
—সুমন কুমার চন্দ্র (BEC EE’98), Hostel -15, 8 & Sen Hall
আমি এখানে শুধু একা আমি নই । কল্পনার রঙে মেশানো এক বাস্তব আমি । এতে অবশ্যই খুঁত আছে, খামতি আছে । মিথ্যে বা অতিশয়ক্তি আছে হয়ত তবে সত্যিও আছে । সমাজ সংস্কার করতে চায় না এই আমি, না চায় কোনো চেনা ছক ভাঙতে। শুধুই মনের কথা মনে করানোর চেষ্টা মাত্র ।
ছোটো বেলায় বাবা–মা, আত্মীয়–স্বজন, বন্ধু–বান্ধব সবার চোখে সেরা হবার জন্য বেশ পড়াশুনা করতাম – অবশ্য সে সবই বেশী নম্বর পেয়ে ফার্স্ট–সেকেন্ড হবার জন্য, কোনো কিছু জানা বা শেখার জন্য নয় । কারণ সবসময়ই তো শুনতাম অমুকের ছেলে কত ভালো রেজাল্ট করে, জয়েন্টে কত ভালো rank করে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কত বড়ো কোম্পানিতে কত ভালো কাজ করে । সে কি কাজ করে বা কাজ করে সে কত খুশী আছে বা এত ভালো কাজ–টাজ করার পরেও তারা ভালো আছে কি না তার খবর কেউ দেয় নি । ধরে নিতাম তারাদের মতোই তারা সবসময় জ্বলজ্বল করছে ।
আমাদের সময় মুড়ি–মুড়কির মতো এত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল না, ভালো কলেজ তো ছিল হাতে গোনা । কিন্তু জয়েন্টে তো চান্স পেতে হবে – না হলে যেন জীবন বৃথা । তাই শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছোটাছুটি করতাম । এ টিচার, ও টিচার, এই কলেজ, ওই কোচিং – তারপর আবার বাড়ীতে এসে পড়া । পড়তে ভালো লাগতো বললে ডাহা মিথ্যে বলা হয় । Organic Chemistry-র মতো এত প্রাণহীন রস কম পেয়েছি জীবনে । কিন্তু তা বললে তো চলবে না । সেই যেমন করে বাবরের বাবার নাম, কোহিনুর কে ঝাপস্ করেছে বা বক্সাইটের বস্তা কোথায় পাওয়া যায় এসব মগজে গুজেছি তেমনি যতটা পেরেছি সব গুজে–ঠেসে–মেখে ব্রেনোলিয়া বয় হয়েছি । পড়াশুনা তো করতে ঠিক চাইনি, করতে হয়েছে – অনেকটা “ডাকছে জয়েন্ট, ডাকছে IIT”-র হাতছানিতে “ও ছেলেরা খেলা ফেলে, শুধুই চল পড়তে যাই”। এতে জীবন–যৌবন ও কিছুটা খোয়া যাচ্ছিল – তবে মন কি আর হার মানতে চায় !মনে মনে তো আমিই অমিতাভ, আমিই শাহরুখ । যেন মেয়েরা আমার স্কুল–কলেজের রেজাল্ট দেখেই ফিদা হয়ে লাইন দেবে আমাকে পাবার জন্য । কারণ আর তো কিছু দেখানোর মতো ছিল না কাকা। চোখে পুরু চশমা বা zero personality দেখে তো আর কেউ ফিদা হয় না । এমন ই ভুলভাল পড়াশুনার মধ্যগগনের এক সময়, IIT-র mock test দিতে গিয়ে দেখি অনেক মেয়েরাও এসেছে। দেখে খুব ভালো লাগল আবার খারাপও লাগল। ভালো লাগল এই ভেবে এরা কত বুদ্ধিমতি, এরা দেশের প্রথম সারির মেয়ে, দেশের গর্ব । খারাপ লাগল এই দেখে যে জীবনের উঠন্ত বয়সেই পড়ন্তের কি করুণ ছাপ। ওদের দিকে তাকিয়ে পড়াশুনার প্রতি সেই প্রথম তীব্র ঘৃণা জন্মায় আমার – পড়া পড়া করে যেন এদেরও সব পুড়ে গেছে।
শুনেছি প্রেমে নাকি বন্ধুতের শেষ আর বিবাহে প্রেমের শেষ। ঠিক তেমনি এই জয়েন্ট-IIT পাওয়া মানে পড়ার ইচ্ছের শেষ আর চাকরী পেলে পড়ার শেষ। জোড় করে আর কত টানা যায়! জয়েন্ট পেয়ে, ভালো কলেজে চান্স পেয়ে, শুধু প্রফেসরদের নোট পড়ে, আবার ভালো নম্বর পেয়ে ভালো চাকরীও জুটিয়ে ফেললাম। চাকরী পেয়ে নিজেকে কি কেউকেটাই না মনে করতাম। অবশ্য আজও করি। আগে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দাদাদের মুখে শুনেছিলাম ragging করা হয় নাকি নবাগতদের স্মার্ট করার জন্য। এটা একটা মহা ঢপ্। মনের খিদে মেটানোর জন্য ragging করা, otherwise না আমার দাদারা স্মার্ট ছিল, না আমরা, না আমার মত আমার ভাইয়েরা। স্মার্ট হতে গেলে বইয়ের বাইরে বেড়িয়ে বাস্তব দেখতে হয়। যারা জয়েন্ট-IIT পায় তারা সাধারণত স্মার্ট হয় না। Calculus জানলে তো আর মেয়েদের মনে জায়গা পাওয়া যায় না খোকা, সেই জায়গা পেতে ইংরাজী জানতে হয়। ‘Like’, ‘I mean’, ‘yeah’ এসব বললে তো নিজের খামতি ধরা পড়ে, ইংরাজীর জ্ঞান নয়। তাই স্মার্ট মেয়েরাও সাধারণত আমাদের কপালে নেই। এটা মেনে নিলেই ভালো, না হলে নিজেরই কষ্ট।
কিন্তু মন কি আর হার মানতে চায়! তাই অনেক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে, অনেক পরিশ্রম করে, অনেক ভালো রেজাল্ট করে, অনেক ভালো চাকরী পেয়ে, অনেক টাকা রোজগার করেও আমি কিন্তু কষ্টে আছি, রেগে আছি, জ্বালায় আছি। শাহরুখের ক্যাটরিনা বা অমিতাভের পরভিন বাবি জুটল না। কারুর জুটল ধন্যি মেয়ে, কারুর আবার গীতা দে–র মত কোমল স্বভাবের গৃহিনী। পরীক্ষার খাতায় এত নম্বর পেয়ে কি হল! অঙ্কটা ঠিক মিলল না তো স্যার! আমি আজ USA-র সিটিজেন, ঘর–সংসার, ছেলে–মেয়ে, দামি বাড়ী–গাড়ী নিয়ে বহাল তবিয়ৎ–এ কিন্তু খুব গুমরে আছি। কাজের সূত্রে কত ট্রাভেল করি, ফ্যামিলি নিয়েও দেশে–বিদেশে ঘুরি। আজ আমার একটা ক্লাস আছে। অবশ্য আমি ছাড়া বিশেষ কেউ আমার ক্লাসে পাত্তা দেয় না। তবু সত্যি কথা বলছি, আমি নিজেকে আজ একটু বিদেশী টাইপ ভাবি – বিদেশীরা অবশ্য আমাকে দেশীই ভাবে আর দেশীরা গুলিয়ে ফেলে। তবে আমি এসবে পাত্তা দিই না । আমি আজ ‘পাসপোর্ট’ কে ‘প্যাস–পোর্ট’ বলি, ‘মাস্ক’ কে ‘ম্যাস্ক’ বলি কিন্তু আমার ইংরাজীতে ভারতের প্রদেশের জেলাস্তরের পর্যন্ত খুব টান আছে। আজও ইংরাজীটা বড্ড বাজে বলি তবে ভাষাটা শিখতেও চাই না আবার জোড় করে বলতেও ছাড়ি না। তাই ‘I mean’, ‘you know’, ‘kind of’ এসব filler ছাড়া sentence শেষ করতে পারি না। তবে সে সব নাটক যাই থাকুক বাবা যদি কেউ Green card বা US Citizen না হয় আমি Indian দের খুব একটা পাত্তা দিই না। Class–এ না match হলে boss আমার অন্যদের কেমন sub-standard লাগে। কাজের জগতে আমি বেশ successful – যেমন ছোটোবেলা থেকে শোনা সেই ভালো ছেলেদের মত। অফিসে আমি বেশ ডাকাবুকো তবে বুকের পাটা ওতটাও বড় নয় যে বাড়ীতে বৌ–এর সামনে বেশী উঁচু গলায় কথা বলতে পারি। তাই বাড়ীর ঝালটা পারলে অফিসে মিটিয়ে নিই, junior–দের ওপর। অবশ্য অফিসে বা বাইরে কোনো সুন্দরী মহিলার সাথে
একটু কথা বলার সুযোগ পেলে মনে হয় ভগবান আজও আছে। রাগ–রোষ টা একটু কমে। ভাগ্যিস পড়াশুনাটা করেছিলাম – না হলে কি এই উষ্ণতাটুকুও পেতাম! তবে সত্যি কথা বলছি ভাই – office–এ আমি Boss কে খুব তেল মারি আর নিজের উন্নতির জন্য একটু–আধটু কাউকে ল্যাং দেওয়া বা politics করাকে আমি খারাপ বলে মনে করি না। Let’s be practical – survivor of the fittest ইয়ার্! এখানে ethics টেনে কি লাভ – কে টানবে ethics–এর boundary?
অনেক দেশ–বিদেশ ঘুরলেও আমার দুনিয়াটা বেশী বড় নয়। প্রচুর facebook friend কিন্তু face value তে কারুর কথা নেওয়া যায় এমন মনের মত friend খুব কম। মদ–মাংসে ভরা পার্টির শেষ নেই তবে কাজ–কর্ম, একটু গান–টান আর সাংসারিক বা পরচর্চা মূলক আড্ডার বাইরে বেশী কিছু কথা হয় না। কাজের বাইরে ঘর–সংসার, দেশ–বিদেশে family trip – ব্যাস। দেশে আজকাল খুব একটা আর যাওয়া হয় না। তবে দেশের ব্যাপারে আমি এখন একটু বেশী critical। অবশ্য কিছু টাকা পয়সা দান–টান করি মাঝে সাঝে দেশের বা নিজের স্কুল–কলেজের কোনো কাজে। । অভাব তো প্রায় কিছুরই নেই – মনের অভাবটা একটু ছাড়া । স্কুল–কলেজের টিচার–দের সাথে connection আগেও ছিল না, আজকাল whatsapp গ্রুপ হয়েছে পুরনো বন্ধুদের কিন্তু অধিকাংশের থেকেই অনেক দূরে চলে এসেছি। বড্ড একা লাগে মাঝে মাঝে, খারাপও লাগে। সময়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি শুধু – এমন ভাবেই কি ভালো ছেলেরা থাকে! ছোটোবেলার সেই ভালো ছেলেরা সাড়া পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তবে এমন ভাবেই অধিকাংশেরা আছে বোধহয়…
**************************************************
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment