সকাল সাড়ে নয়টা. শীত পেরিয়ে বসন্ত উঁকি দিচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একলা তিলোত্তমা নিস্পৃহ দুচোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সাদা কালো মোড়কে ঢাকা জীবনে রঙের ছোঁয়াটুকু পায়না ও।
হৃদয়ভাঙ্গার কষ্ট সামাল দেয়ার আগেই খারাপ রেজাল্ট, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, মা-বাবার আশাপূরণ না করার দুঃখে ভেঙে পড়ে সে। অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার ইচ্ছাও নেই আর।
” কতক্ষণ ধরে ডাকছি, আয় খেয়ে উদ্ধার কর”
মায়ের চিৎকার শুনে বিনা বাক্যব্যয়ে কোনরকমে ভাত খেয়ে পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।
না আজ সে কলেজ যাবেনা। প্রফেসর রোজকার তিরস্কার, বন্ধুদের নিষ্ঠুর সব কথা খুব আঘাত করে ওকে। কাউকে ওর কিছু বলার নেই। কারো থেকে কিছু শোনার নেই। ও ভাবল কেন বে৺চ আছে, সবার কাছেই বড্ড অনভিপ্রেত, উচ্ছিষ্ট ও। Esplanade থেকে সোজা হাঁটতে শুরু করল ও। চারিদিকে চরম ব্যস্ততা , কারো এক মুহুর্ত দাঁড়াবার সময় নেই, সবাই ছুটছে, শুধু ছুটছে। তিলোত্তমা কি তাহলে মূল্যহীন আর ‘good for nothing’?
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরের কত অভিমান, অনুযোগ ঝড়ে পড়ছে চোখের জল হয়ে। আকাশের পাখি, Eliot park এর ফোয়ারা, lamppostএর পাশের বোগেনভেলিয়া, ভিক্টোরিয়ার কাঠবেড়ালি, রঙিন প্রজাপতি, পথের ধারের অজস্র নামহারা ফুল। ময়দানের খোলা হাওয়া, একলা বেঞ্চ। এরা কত সুখী, তাই না? নিজের খুশীতে বাঁচে, তাদের সিদ্ধান্তে সমালোচনা করার কেউ নেই, না আছে অর্থহীন প্রতিযোগিতা।
” আগে কখনো ভাবিনি এসব। মনেই পড়ছেনা কলকাতাকে এত কাছ থেকে অনুভব করেছি!” ভাবতে ভাবতে তিলোত্তমা ঢোকে St. Pauls Churchএ। চোখ বুজে চার্চের মধ্যে অনেকক্ষন বসে থাকে সে। ও বোধহয় বাঁচতেই ভুলে গেছে। ভুলে গেছে মনের কথা শুনতে, প্রশ্ন করতে! বেরিয়ে গোলাপী রঙের একটা মোমবাতি জ্বালালো ও। মনটা কেমন শান্ত লাগছে, অনেকটা ভার নেমে গেছে অশ্রুধারায়, একাকীত্বের মাঝে পেয়েছে খুঁজে সৌন্দর্যকে। ” কেন সবাইকে একিরকম হতে হবে? বৈচিত্র্য তো অনেকবেশী আকর্ষণীয়। “
এক তিলোত্তমা অন্য তিলোত্তমার সাথে একদম অন্যভাবে পরিচয় হচ্ছে। কলকাতার মধ্যে অদ্ভুত একটা যাদু আছে, একটু ভালোবাসলেই অনেকটা ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয় এই শহর।
সেদিন ও নন্দনের লেবুচা, ময়দানের পাপড়িচাট, বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাত সবকিছুর মধ্যে একটা অন্য আমেজ পাচছিল তিলোত্তমা। তারপর মেট্রোয় উঠে সোজা রবীন্দ্র সরোবর। ঢুকেই লেকের ধারে একলা বসে সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। পড়ন্ত বিকেলে টকটকে লাল সূর্য, বাকি আকাশটা হলুদ, কমলা – আর তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জলের বুকে। শান্ত হাওয়া, মাঝেমধ্যে কটা পাতা ঝরে পড়ছে, ফড়িং, হাঁস, পাখি যেন একটা ছন্দে বাধা পরস্পরের সাথে। অকৃত্রিম ভালবাসায় ভরে যাচ্ছে ওর প্রাণ। আস্তে আস্তে ও যেন ফিরে পাচ্ছে ওর আত্মবিশ্বাস। আত্মগ্লানি ভুলে সেও চোখে স্বপ্নের কাজল পড়ছে।
” What is this life, if full of care,
we have no time to stand and stare!”
মনে পড়ে গেল লাইনদুটো। বিকেলটা শেষ হয়ে আসছিল, যদিও ও বুঝেছিল শেষের পরে অনেককিছু বাকি। ও বুঝেছিল যে ” She has everything she needs”. তার লড়াইটা একান্ত তার-ই । ” The outer world is never going to change, it’s her inner world she needs to concentrate upon”.
সেদিন বাড়ি ফেরার পরেও অনেক ঝড় এসেছে ওর জীবনে, তবে এখন সে আলো হোক বা অন্ধকার- দুইয়ের মধ্যে উজ্জ্বলতা খুঁজে পেতে শিখে গেছে। কারণ এখন ও নিজেকে ভালবাসতে শিখেগেছে।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment