চলতে চলতে হঠাৎ রিনি রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে পড়ল। পাশে পাশে রিনিকে দেখতে না পেয়ে সলিল পেছনে তাকিয়ে দেখে রিনি ফুটপাতে বসে কি যেন খুঁজছে।
“কি হলো? কিছু পড়ে গেছে নাকি”?
“না কিছু নয়, তুমি চলতে থাক আমি আসছি”।
সলিল ফিরে এল রিনির কাছে। “কি হয়েছে, কিছু পড়ে গেছে”?
“না, আমি সেপটিপিনটা খুঁজছি, এখানেই পড়ে গেল ব্যাগ থেকে”।
সলিলও বসে পড়ে খুঁজতে লাগলো, “সেপটিপিন দিয়ে কি করবে তুমি? এই নাও”। সলিলই খুঁজে পেল ওটা।
“এই যে দেখোনা চটির স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গেলো, এটা সেপটিপিন
দিয়ে না আটকালে খালি পায়ে চলতে হবে আমাকে”। সলিল অপেক্ষা করে রইল, প্রায় দশ মিনিট লাগলো রিনির চটি সারাতে। ঠিক মুচিদের মতো সারানো চটি পরে দুচারবার হাঁটাচলা করে নিল ফুটপাতের ওপর,
তারপর এক গাল হেঁসে বলল, “নাঃ এবার আর ছিঁড়বেনা”।
কদিন আগে এসপ্ল্যানেডে মেট্রো সিনেমার কাছাকাছি হঠাৎ থেমে পড়ে বলে, “আমার দিকে পেছন করে একটু আড়াল করে দাড়াও তো, আমার ব্লাউজের বোতামটা ছিঁড়ে গেছে একটা সেপটিপিন লাগাবো”
সলিল তো তাজ্জব। এ মেয়েটা বলে কি? এই জনাকীর্ণ রাশিরাশি পথচলা লোকজনের মাঝখানে ওকে আড়াল করে রাখতে যাতে ও ব্লাউজের বোতাম সেলাই
করতে পারে। এহেন অদ্ভুদ কথা সলিল বাপের জন্মে শোনেনি। কিন্ত উত্তেজিত না হয়ে শান্তভাবে বলল “শাড়ীর আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নাও, চল রাস্তা ক্রশ করে
ওপারে ট্রাম গুমটির কাছে একটা বাথরুম আছে ওখানে গিয়ে তুমি ব্লাউজ ঠিক করতে পারবে”। রিনি বাধ্য মেয়ের মতো সলিলের কথা শুনল। ট্রাম গুমটির সামনে গিয়ে সলিল বলল “যাও ঐ যে বাথরুমটা, আমি এখানে দাঁড়িয়ে রইলাম”। রিনি চলে গেল।
সলিল ভাবতে লাগলো এইরকম মেয়ে সে একটাও দেখেনি। প্রথম প্রথম ভাবতো মেয়েটা একটু ছিটেল আছে। কিন্তু যত দিন আচ্ছে দেখতে পাচ্ছে মেয়েটা সাধারনের থেকে আলাদা। ১৮ বছর বয়সে খুবই ভাল রেজাল্ট করে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে, বুদ্ধিশুদ্ধি প্রখর, কথাবার্তায় চমক আছে, আত্মসন্মান জ্ঞান অসম্ভব কিন্তু কিঞ্চিৎ পাগলাটে। কে জানে বংশে কেউ হয়তো পাগোল ছিল।
একদিন রেড রোডের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাম আসতে দেখে রিনি সলিলকে বলল, “চল ঐ ট্রামটাতে উঠে পড়ি তাহলে এসপ্ল্যানেড যেতে আমাদের আর হাঁটতে হবেনা”। “কিন্তু ওটা তো উল্টোদিক থেকে আসছে, আমাদের ট্রাম লাইন পেরিয়ে ওদিকে যেতে হবে তো”। “তুমি এসোতো আমার সঙ্গে”। বলে সলিলের হাতটাকে শক্ত করে ধরে একলাফে চলন্ত ট্রামটার সামনে দিয়ে লাইনের ওপারে লাফ মারল। ট্রা্ম ড্রাইভার জোরে ব্রেক কষে ট্রামটা থামিয়ে দিল। ওরা দুজনে টপ্ করে ট্রামে উঠে পড়ল। সব্বাই হতভম্ব হয়ে গেছে এই ছেলে মেয়ে দুটোর কাণ্ড দেখে। সেদিন দুজনেই ট্রাম চাপা পড়ে যেত।
সবচাইতে চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়েছিল গতবছর কালিপূজোর আগের দিন। হাজরার মোড় থেকে দুজনে গল্প করতে করতে কখন হেঁটে হেঁটে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে পৌঁছে গেছে দুজনের কারোরই খেয়াল নেই। কথা বেশী রিনিই বলে, সলিল বেশীরভাগ সময় শুনে যায় কারন রিনির কথাবার্ত্তায় চমক্ আছে যটা সলিলের জানাশোনা কোনও মেয়ে বা ছেলের মধ্যেও আছে বলে জানা নেই। ওর কথা শুনতে সলিলের ভালো লাগে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে বেশ কিছু আইসক্রীম ভেন্ডাররা ঘোরাঘুরি করে। রিনি আইসক্রীম খেতে খুব ভালোবাসে, বাইরে বেরোলে চোখে আইসক্রীম দেখলেই ওকে একটা কিনে দিতে হয়। কিন্তু আজকে আর তা করলনা, বরং নিজের
ছোট পার্সটা সলিলের হাতে দিয়ে বলল, “তুমি এটা তোমার পকেটে ঢুকিয়ে রেখে দাও। আমি হাজার চাইলেও আমাকে দিওনা। ডাক্তার আমার আইসক্রীম খাওয়া বারন করে দিয়েছে , তুমিও কিনে দিওনা, আর আমাকেও কিনতে দিওনা। সলিল কোনও কথা না বলে রিনির পার্সটা পকেটে ঢুকিয়ে নিল। তারপর দুজনে মিলে ময়দানে ঘাসের উপর বসল, গল্প করতে করতে রিনির চোখ কেবলই আইসক্রীমের গাড়ীর দিকে চলে যাচ্ছে কিন্তু এগোতে পারছেনা। হঠাৎ করে বলে উঠল, “যাই একটা আইসক্রীম কিনে আনি। একটা খেলে কিছু হবেনা, কি বল”? সলিল উত্তর দিল, “ডাক্তার যখন বারণ করেছে একটা দিন নাহয় নাই বা খেলে”। শুনে একটু সময় চুপ করে থেকে রিনি বলল, “না কিছু হবেনা। দাও একটা কিনে দাও”। সলিলেরও কেমন জেদ চেপে গেল, “না আজ তোমার আইসক্রীম খেতে হবেনা, আমিও কিনছিনা।“ এদিকে কিছুক্ষণ আগে বলে রেখেছিলো যতই চাক পার্সটা যেন সলিল কোনওমতেই তাকে না দেয়। ভূলে গেল সেকথা? সলিল জোর দিয়ে বলল, “না তোমার পার্সও আমি দেবনা”। রিনি প্রথমে কাকুতি মিনতি শুরু করল, তারপর আস্তে আস্তে গলা চড়তে শুরু করল রিনির, চারপাশে লোক জড়ো হতে শুরু করেছে। শেষপরয্যন্ত রিনি চীৎকার করে বলতে শুরু করল, “শীগগির আমার টাকা দিয়ে দাও তা না হলে আমি পুলিশ ডাকবো”। রিনির এইরকম চেহারা সলিল কোনওদিন দেখেনি। চারপাশের লোকজন ভাবতে শুরু করল লোকটা মেয়েটাকে ভোগ করে পয়সা না দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সলিল দেখল রিনি যেরকম রেগে গেছে হয়তো লোকগুলো সলিলকে ধরে
মারধোর করতে পারে। অগত্যা পকেট থেকে পার্সটা বার করে দিয়ে দিল। রিনি একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দৌড়ে বাস স্টপেজে গিয়ে একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল সেটাতে উঠতেই বাসটা ছেড়ে দিল। সেদিন সলিল প্রতিজ্ঞা করল আর কোনওদিন রিনির সঙ্গে দেখা করবেনা। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পেরেছিলো কি?
তা না হলে এই পাগোল মেয়েটার হাত ধরে জীবনের এই দরজায় এসে পৌছতে পারত কি?
প্রতিজ্ঞা তো রাখতে পারলো না সলিল, দুদিন কোনওমতে কাটালো তিনদিনের দিন সন্ধের দিকে গুটিগুটি রিনিদের বাড়ীর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল সে। রিনির মা দরজা খুলে দিয়েই রিনিকে ডেকে দিল। রিনি এসে একগাল হেঁসে বলল ‘এইমাত্র বুলা এসেছিলো’। বুলা সলিলের বোন। ‘কেন?’ সলিল জিজ্ঞেস করল। ‘কেন আবার এমনি, গল্প করতে’। তাইতো, সলিল ভাবল বুলা তো রিনির বন্ধু এমনিতে। রিনির হাবভাব দেখে মনেই হলোনা দুদিন আগে সে কি কাণ্ডটা ঘটিয়েছিলো।
সলিল আর কিছু বলবার আগেই রিনির বাবা ঘরে ঢুকলেন। ওনাকে সলিল খুবই সমীহ করে। ভদ্রলোক চোখে দেখতে পান না কিন্তু তাই নিয়ে কোনওদিনও ক্ষোভ প্রকাশ করেন না। মুখে সর্ব্বদা হাঁসি লেগে রয়েছে আর খুব গল্প করতে ভালোবাসেন। খবর শুনে শুনে সারা পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে তা সমস্তই জানা ওনার। যথেষ্ট জ্ঞ্যানী মানুষ এবং খুবই বিদ্বান, শুনেছে উনি আই এস সিতে ফোর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু চাকুরী জীবনে গোড়াতেই gradual optic nerve atrophy নামে একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে উনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। রিনিকে উনি ঝুমকি বলে ডাকেন।এই মেয়ে হচ্ছে ওনার অন্ধের যষ্টি। আর রিনিরও অন্ধ বাপের ওপর অগাধ পিতৃস্নেহ, হ্যাঁ পিতৃভক্তি বললে কম বলাই হব, তাই পিতৃস্নেহটাই ঠিক উপমা।
সলিল এবং সবাই দেখে রিনি যখন তার বাবাকে নিয়ে কোথাও যায় মা যেমন তার বাচ্চাকে আগলে আগলে নিয়ে যায় রিনি ঠিক তেমনি করেই তার বাবাকে সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে যায়। কথা প্রসঙ্গে কতবার বলেছে ও ওর একটা চোখ বাবাকে দান করতে চায়। সলিলের কাছে এই ভাবনা অভূতপূর্ব এবং অশ্রুতপূর্ব। ওনার সঙ্গে কথা
বলতে সলিলের খুবই ভালো লাগে। ওনার কাছেই ঝুমকির অনেক কঠিন অসুখ এবং বহূ দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে আসার গল্প শুনেছে।
রিনির সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ চলতেই থাকলো, সলিল এখন রিনির পাগলামীটা নিয়ে বেশী মাথা ঘামায় না। এর মধ্যে এদিকে দেশে চাকরী বাকরী পাওয়া দুস্কর, শয়ে শয়ে বেকার ইঞ্জিনীয়ার। সলিল একটা ছোটোমোটো ব্যাবসা শুরু করেছে এক বন্ধুর সঙ্গে, আর আমেরিকা চলে আসবার প্রস্তুতিও চলছে সেই সঙ্গে। দিন যায়, মাস যায়, বছর কেটে গেল। একদিন পূর্ণিমার রাতে রিনিকে জানালো যে সে আমেরিকায় চলে
যাচ্ছে। রিনি বলল, “ওখানে গিয়ে তুমি মেমসাহেব দেখে আমাকে ভূলে যাবে নাতো”? “আর যাই হোক ইংরজীতে চাঁদ দেখাইতে পারুম না”। শুনে রিণি হো হো করে হেঁসে উঠল।
অতঃপর যাবার আগে সলিল বহূ বাধা বিপত্তি, আপত্তি, ধমকানি, বাড়ীর গুরুজনদের কথা, বন্ধুদের সদুপোদেশ, টিটকিরি “ঐ মেয়ে বিয়ে করলে তুই বেশীদিন বাঁচবি না”, “তোর শ্রাদ্ধে আমেরিকায় নেমন্তন্য খেতে যাব,” ইত্যাদি ইত্যাদি এ সমস্ত কিছু অগ্রাহ্য করে এই ছিটেলগ্রস্থ, দঃসাহসী, দূর্ঘটনাপ্রবন, অদ্ভূদ চরিত্র, অতিশয় বুদ্ধিমতী এবং অপার করুণাময়ী রিণি ওরফে ঝুমকিকে বিয়ে করে বিদেশে ভাগ্য অন্বেশনে বেরিয়ে পরল। পাঁচমাস পরে রিনি উঠল প্লেনে জীবনে প্রথমবারের মতো। আগেরদিন সারারাত বাপের পিঠে মুখ গুঁজে কেঁদেছে। বাবা, মেজোমামা সবাই সান্তনা দিয়েছে যে বাবাকে দেখার অনেক লোক আছে, চিন্তার কারণ নেই। এয়ারপোর্টে সলিল ওর দুই বন্ধু অলোক আর মনীষ এবং তার বৌকে নিয়ে রিনিকে তুলতে এসেছিলো। রাস্তায় রিনিকে হাজার রকম দেশের খবরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শেষ হলে মনীষের বৌ তার ঝোলা খুলে বসল। তার বিয়েতে তার বাবা ৮০ ভরি সোনার, জড়োয়ার সেট, মুক্তোর সেট, মনীষের হীরের আংটি, সুইস ওয়াচ থেকে কলকাতার সব চাইতে নাম করা ডেকরেটরকে দিয়ে বিয়ের প্যাণ্ডেল তৈরী, বিলায়েত খাঁর ছাত্রকে দিয়ে নহবৎ বসানো এই গল্প শুনতে শুনতেই তারা বাড়ী
পৌঁছে গেল। রিনি কিছু বলার আগেই সলিল জানিয়ে দিলো এই ফ্ল্যাটটা সে সাবলেট নিয়েছে এক গুজরাটি ভদ্রলোকের কাছ থেকে তিনমাসের জন্য। ওরা রাত দুটো থেকে দুপুর দুটো অবধি ঘুমোলো। ঘুম থেকে উঠে আলাপ হল প্যাটেলের সাথে। তিনি জানালেন মনীষ চারবার ফোন করেছিলো, সলিলদের ওদের বাড়ীতে খেতে যেতে বলেছে। সলিল সঙ্গে সঙ্গে মনীষকে জানিয়ে দিল যে ওরা কিছুক্ষনের মধ্য আসছে। প্যাটেল চলে গেল। ওরা রেডী হয়ে বেরোবার মুখে রিনি বলল, “তুমি কেন সকলের কথা না শুনে আমাকে বিয়ে করতে গেলে? তাহলে কত বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে হতে পারতো”। সলিল রিনির মোটা লম্বা বিনুনীর গোড়াটা একটু নেড়ে দিয়ে বলল, “ঝুমকি ইয়ার, বাত এহি হ্যায় কি দিল লাগে গাদ্ধিসে তো পরী কেয়া চীজ হ্যায়”। “এ্যাঁ তুমি আমাকে গাধা বললে”? “ঐ কাছাকছি। এখন চল তো ওদের বাড়ী যাই, খুব খিদে পেয়েছে। আর তুমিও দেখো বড়লোকের মেয়েদের
কাছ থেকে কিছু আদব কায়দা শিখে নিতে পার কিনা”। রিনি সলিলকে একটা চিমটি কাটল। এবার দুজনেই হেঁসে ফেলল। সলিল রিনির কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চল, যাই বড়োলোকের মেয়েদের রান্না কেমন খেয়ে আসি”। রিনিও সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ চলো যাই’।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment