মহালয়ার দিন। খুব ভোরের ফ্লাইট ধরে চেন্নাই যাচ্ছি। US থেকে কাজের সূত্রে India গেছি Chennai office-এ offshore-এর team meet করার জন্য। তবে সেটা আংশিক সত্য, এমনভাবে plan-ও করেছি যাতে বহুবছর পর কলকাতায় বাড়ীতে কিছুদিন কাটানো যায়। পুজোয় ছোটবেলায় যেমন পাগলের মত প্যান্ডলে-প্যান্ডলে ঘোরার নেশা ছিল আজ আর তা নেই তবে সেই ২০০৮-এ, যে বছর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল তার পর থেকে শুধু একটা মাত্র বছর পুজোয় বাড়ী ছিলাম। মা-র কাছে পুজোর দিন-কটা বাড়ীতে থাকাটাও আজ একটা বড় প্রাপ্তি। আমার থেকে মার কাছে আরও বেশী খুশীর ব্যাপার – প্যান্ডলে মা দুর্গা ছেলেমেয়ে নিয়ে যেমন ভরাট করে বিরাজ করে, মা-রও নিশ্চয় মনে হবে অন্ততঃ এ বছর মা তার দুই ছেলে ও তাদের পরিবার নিয়ে একসাথে আছে। সব খুশী,আনন্দ-ই ক্ষণিকের, তাও এমন ক্ষণিকের মহাস্বস্তি, মহাশান্তির-ও আজ বড্ড অভাব। তা কলকাতা পৌঁছেছি দিন দুই আগে। আজ খুব ভোরের ফ্লাইট ধরে চেন্নাই যাব আর ষষ্ঠীর দিন আবার বাড়ী ফিরে আসব। দমদম এয়ারপোর্টে খুব সকালে পৌঁছতে কোনো ক্লান্তি লাগেনি আজ – যদিও দক্ষিণ কলকাতার একপ্রান্ত থেকে এই এয়ারপোর্ট পৌঁছতে আমার ঘন্টা দেড়েক সময় লাগে, আগেও যেমন লাগত। সেই একই রাস্তা, একই ফ্লাইওভার, প্রায় একই সারি-সারি দোকান-বাড়ী-হোটেল-ফ্ল্যাট পাশে ফেলে এগিয়ে যাওয়া তবু মনে শরতের একঝাঁক খুশী – রাস্তায় আসার পথে রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের “য়া দেবী সর্বভূতেষু, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা..” শোনা, যে উচ্চারণ আর কন্ঠস্বর মরণের দিন পর্যন্ত আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে – শিশিরে ভেজা এক অনাবিল খুশীতে ভরপুর হয়ে আমি কখন যে Indigo-তে board করলাম প্রায় বুঝতে পারিনি। খুশীতে ছেদ পড়ল যখন বুঝলাম আমাকে middle seat-এ বসতে হবে। ছোটো distance-এ দিনের বেলায় flight-এর window seat আর long distance-এ always isle seat – এ আমার hard coded rule বা preference। যাই হোক এখন আর উপায় নেই, স্নিগ্ধ সকালে ঘন্টা আড়াই sandwich হয়ে বসে থাকতে হবে।
আমার দুই পাশের seat-এই দুটি অল্পবয়সী মেয়ে বসে। আমার হঠাৎ-ই মনে হল মা দুর্গা মর্ত্যে গেছে বলে কি আমাকে কলির কেষ্ট মনে করে এই আকাশপথে সরস্বতী-লক্ষ্মীর মাঝখানের position-টা এই ২-২.৫ ঘন্টার জন্য দিয়ে গেল না কি! অবশ্যই এ এক আজগুবি চিন্তা মনে হওয়া, ডান-দিকের মেয়েটি তার বাড়ীর কাউকে ফোন করে বাংলায় বলছিল এবার flight ছাড়বে, মন খারাপ কোরোনা ইত্যাদি। আজগুবি চিন্তার রেশ তখনো পুরোটা কাটেনি, মনে হল সরস্বতী-লক্ষ্মীরও boyfriend থাকাটাই স্বাভাবিক, তাদের কেই কিছু প্রেমময় বার্তা দিচ্ছে। তবে এই বার্তার মধ্যে একটা করুণ সুরও কানে আসছিল তাই আমার আজগুবি চিন্তাটাও শেষ হচ্ছিল। Boyfriend নয়, হয়ত কোনো বাচ্চাকে বলছে কথাগুলো। হঠাৎ করে উপযাচক হয়ে কেষ্ট জিজ্ঞেসও করতে পারে না case-টা কি। একরকম মুখচোরা হলেও flight-এ আমার আশে-পাশের co-passenger-দের সাথে মাঝে-মাঝে ভালোই কথাবার্তা বলি, তার ভালোই experience আমার আছে। রাশিয়ার মেয়ে Anna, যে আমাকে music শেখার জন্য প্রচুর ফান্ডা দিয়েছিল এবং যার সাথে আজও ভালো online বন্ধুত্ব আছে তার সাথে আমার প্রথম আলাপ flight-এ, Singapore-এ। Prasad, ব্যাঙ্গালোর-এর ছেলে, যে আমাকে আজও বলে ব্যাঙ্গালোর এলে তার বাড়ীতে যেন যাই তার সাথে আমার প্রথম আলাপ হায়দ্রাবাদ-গামী flight-এ। তাই পাশের মেয়েটির সাথে কথা বলার ইচ্ছাও হচ্ছিল তবে culture, gender বা কে-কি ভাববে এসব ভাবনাও উঁকি দিচ্ছিল।
‘পুজোর সময় কি কলকাতা ছেড়ে যাওয়া পোষায়?’ এমনই কিছু একটা স্বগতোক্তি করে কথা শুরু করেছিলাম। চেন্নাই আমার প্রাণের শহর – এমন তো নয়ই তবে তাকে নিন্দা করার ইচ্ছা আমার ছিল না,
একমাত্র কারণ মেয়েটির সাথে কথা শুরু করা। শুরুও হল, মনে চেন্নাইকে ভালোও লাগল কারণ তাকে গালি না দিলে আবার অন্য কি আগড়ুম-বাগড়ুম বলতে হত কে জানে। তবে ‘আপনি’ দিয়ে কথা শুরু হল, মন ‘তুমি’ চাইলেও শালা কে আমাকে ‘তুমি আমার প্রাণনাথ’ বলে ঝাঁপাবে? তবে এটা ঠিক যে – আমি যেমন ঋতুপর্ণ ঘোষের মত সাধারণত কাউকে ‘তুই’ বলতে পারি না তেমনি ‘আপনি’-র থেকে ‘তুমি’-তে বেশী স্বচ্ছন্দ – সেটা gender ও age agnostic সত্যি কথা। কিছু মানুষ পাওয়া যায়, হয়ত আমরা সবাই জীবনে মাঝে-মাঝে পাই, যার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। এই ভালো লাগার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই কিন্তু মন বোঝে। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে আধঘন্টায় উত্তরণের মাঝে এটা জেনে গেছি উমা চেন্নাইতে কাজ করে, যদিও লেখাপড়া কলকাতায়, original বাড়ী শিলিগুড়িতে, এখন কলকাতাতেও ফ্ল্যাট আছে। কয়েক বছর কলকাতাতেও কাজ করেছিল কিন্তু এখন চেন্নাই-তেই থাকে। Office-এর boss খুব ভালো লোক তবু সত্যিই কাজের চাপ থাকার জন্য এই পুজোর সময়-ও কলকাতা ছেড়ে চেন্নাই যেতে হচ্ছে। Covid-টা আগে আসলে এই চাপটা হত না কিন্তু কি আর করা যাবে, রোজগার ছেড়ে তো আর পুজো হয় না। বড় বড় কথা আমি সাধারণত বলি না, তার প্রধান কারণ আমি বড় সড় কেউ নই – তার সাথে যখন বুঝলাম উমার কথাবার্তাগুলো সোজাসাপ্টা, কেতাটা কম তখন আরও ভালো লাগলো। আমি দু-একজন কয়েকটা close বন্ধু ছাড়া কোনো ভারতীয়কে, বাঙালী তো নয়ই, বলতে শুনিনি যা উমা অকপটে বলল – ‘অফিসে যখন client-দের সাথে tele-conference হয় আমি বাবা অত ভালো ইংরাজী খুব একটা বলে উঠতে পারি না’, আমার সত্যিই খুব ভালো লাগলো। নিজের খামতির কথা অকপটে কোনো মেয়েকে অজানা অচেনা কাউকে বলতে শুনিনি, তাও flight-এ যাতে চড়লেই অধিকাংশ বাঙালী বা ভারতীয় মাতৃভাষা ভোলে। যেন ইংরাজী না বললে মানুষ cattle class-এ পড়ে flight-এ, সে যত শ্রুতিকটু ইংরাজীই হোক না কেন। তবে দেখলাম উমার না ইংরাজী খারাপ আর বাংলার ওপর দখল খুব ভালো। গল্প-কবিতা পড়ে বা পড়ত বোঝা গেল, ভালো গান গায় এমনও একটা আভাস পেলাম যদিও আমি গানে গন্ডমূর্খ তাই আমার এ ব্যাপারে বলা ঠিক সাজে না।
উমার সাথে কথা বলতে বলতে একবার জানলার বাইরে চোখ পড়ল। শরতের রাশি-রাশি মেঘপুঞ্জ বাংলা-উড়িষ্যায় ফেলে এসেছি মনে হল। তবে আকাশ খুব পরিষ্কার, দু-এক টুকরো করে হালকা তুলোর মত মেঘ নীচে দেখা যাচ্ছে – আরও অনেক নীচে, ৩৩০০০ ফুট দূরে, সমতলে পুজোর কিছু চোখে পড়ল না। অবশ্য পুজোর রেশের থেকেও অনেক বেশী enjoy করছিলাম উমার সাথে দারুন গল্পে। কলেজ life বা হায়দ্রাবাদ থাকাকালীন আমার কিছু অভিজ্ঞতা বা কাজের জগতের কিছু মজাদার ঘটনা share করায় ওর প্রাণখোলা হাসিতে আমার যতটা ভালো লাগছিল আমার বাঁ-দিকের মেয়েটির হয়ত ততটাই বিরক্তি লাগছিল। সে মেয়েটি, মনে হল অ-বাঙালী, হয়ত ভাবছে এই কপোত-কপোতির পরিচয় এই flight-এই তো হল, এতেই এত গল্প-হাসি-ঠাট্টার কি আছে, যেন কত মিষ্টি প্রেমে ভরা, গা জ্বলে যায় এমন বেহায়াদের দেখলে! তাকে বা অন্য কাউকেই বোঝানো মুশকিল সব পরিচয়ের ভিত্তি-ই সময়ের ওপর নির্ভর করে না। হাওয়ায় ওড়া flight-এ এক মিষ্টি বন্ধুত্বের শুরু একটু আগে হলেও, তা হাওয়ায় ফুরুৎ করে উড়ে যাবার মত ক্ষণস্থায়ী হতেই হবে তাও নয়। উমারা better বোঝে authenticity, simplicity, লোকেদের ঈঙ্গিত, সামাজিক চাউনি, লজ্জা-সম্ভ্রম-মর্যাদা বোধ। আমাদের গল্প থেকে ততক্ষণে উমা জানে আমার wife-এর নাম বিপাশা, বিবাহিত হলেও আমরা better as friends than typical husband-wife, শুনেছে আমি খুব একটা responsible husband নই, তবে তার জন্য বিপাশার আমার প্রতি ভালোবাসার একটুও খামতি নেই। আমি জেনেছি উমা একজন single mother, তার চোখের মনি তার মেয়ে যাকে পুজোর সময় দাদু-দিদিমার কাছে রেখে multinational company তে কাজে ফেরত যাচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়েছি যখন শুনলাম উমা তাদের office-এর open house-এ সবার সামনে US-থেকে আসা ওদের company-র CEO-কে বলেছে, rather suggest করেছে, মেয়েদের day-1 of period in each month work-from-home করার flexibility দেবার। উমার ‘marriage’ system টার ব্যাপারে romantic, মিষ্টি feeling আছে কিন্তু নিজের বিয়ের অভিজ্ঞতা অত মিষ্টি নয়। তাই
‘independence’-এর ওপর বেশী আস্থা তবে ছেলে মানেই বেইমানের দল এমন একতরফা রুক্ষ ভাবও পোষণ করে না।
দু-আড়াই ঘন্টার flight-এ আকাশপথে এমন অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম। নিছক হাসি-ঠাট্টা দিয়ে শুরু হয়ে বেশ কিছু personal কথাবার্তা exchange করার মধ্যে দিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হল উমার সাথে এই যাত্রায়। আমরা এত কথাবার্তা share করার মাঝে মুহুর্তের জন্যও শালীনতা লঙ্ঘনের লেশ পর্যন্ত দেখিনি। সময়ের জ্ঞান ছিল না, জ্ঞান ফিরল যখন flight-এ announce করল এবার আমরা Chennai-এ নামব। আকাশ থেকে মাটিতে নামলাম, যে যার জায়গায় পৌঁছবার জন্য। ছোটোবেলায় পড়েছিলাম ‘ঈশ্বরী পাটনী’ যেখানে পাটনী মা দুর্গাকে নৌকায় পার করে দিয়ে নিজের সন্তানের দুধে-ভাতে থাকার প্রার্থনা করেছিল এবং পরে দেবীর পরিচয় বুঝতে পেরেছিল। আমার অভিজ্ঞতা বার বার আমাকে এক নতুন ‘ঈশ্বরী পাটনী’র কথা মনে করাচ্ছিল। জানি এখানে প্লট আলাদা, যুগ আলাদা, চরিত্রও এক নয় – তবুও এক নতুন ঈশ্বরীর কথা মনে হচ্ছিল। না, আমি কাউকে পার করাইনি, এখানে ঈশ্বরী দেবী নয় – মানবী, বান্ধবী, আজকের নারী। যার কোনো পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা নেই, নিজেই খেয়া পারাপার হতে পারে। নিজের সন্তানের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে – স্বাধীন, সাহসী, সদাহাস্য, সহিষ্ণু, আত্মবিশ্বাসী তবে তার সাথে আছে ত্যাগ, কষ্ট, সমাজের কু-চাউনিকে উপেক্ষা করার সাহস। আর আমি. কোনো মাঝি নই কিন্তু এক পারাপারের সাক্ষী। সাক্ষী কোনো দেবীর নই, রক্ত মাংসে গড়া, ভুল-ঠিকে মেশানো একটি অল্প বয়সী মেয়ের। কল্পনার দেবী নৌকার পাটাতন সোনায় মুড়তে পারে কিন্তু বাস্তব জীবনের দেবী এই উমারা। তাদের জীবন নানা রকমের, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র বা স্তর থেকে উঠে আসা উমারা শেখায় সন্তানের দুধ-ভাত অর্জন করতে হয়, শুধু আশীর্বাদে পাওয়া যায় না। শেখায় প্রতিদিন রাস্তায়-ঘাটে-অফিসে-বাজারে-বাসে-ট্রেনে বা প্লেনে যাদের দেখি তাদের মধ্যেই ঈশ্বরীর অধিষ্ঠান, মন্দিরে-প্য।ন্ডলে নয়। দেবীরা পাটনীদের শেখায় প্রাত্যহিক কাজে বা জীবনধারনের চলাতেই একধরনের পূজা।
চেন্নাই এয়ারপোর্টের বাইরে তখন চড়া রোদ, এয়ারপোর্টের A.C-.র চাদর সরে গেছে। ভুলে গেছি শরতের শারদীয় স্নিগ্ধতা। তবে daily life-এর ছোটাছুটির মধ্যেও পুজোর এক স্বাদ অনুভব করলাম। চেন্নাই এয়ারপোর্টের বাইরে একটা বিশাল জাতীয় পতাকা আছে যেখান থেকে uber taxi গুলো ছাড়ে। “উমা তুমি খুব ভালো থেকো”। “তুমিও খুব ভালো থেকো” বলে উমা uber-এ চড়ে চলে গেল। ওপরে দেখলাম জাতীয় পতাকাটা চড়া রোদের মধ্যে বেশ জোরে উড়ছে।
quite good
Comment by dchaudhuri — March 11, 2024 @ 8:20 am