আয়েষার সংগে যখন পরিচয় হয় তখন তার বয়স ঊনিশ কি কুড়ি – সাদাম হুসেইন প্রাসাদের এক তলারঅফিস ঘরে। আমাকে সাহায্য করার উদ্যেশ্যে তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। তার কয়েকদিন পরে তারস্বামীকেও নিয়োগ করা হয়েছিল। নাম আবিদ। আয়েষার কাজ ছিল সাদাম প্রাসাদের বিভিন্ন অফিস থেকে ফাইলজড় করে আনা, আর আবিদের কাজ ছিল যেসব অফিস প্রাসাদের বাইরে আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া। তারাদুজনে আমাকে প্রায় পাঁচ মাস ধরে সাহায্য করেছিল অর্থাৎ যদ্দিন আমি বাগদাদে ছিলাম।
ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শুধু বাগদাদ শহর নয়, পুরো দেশটাকেই আমেরিকা দখল করেছিল। এই যুদ্ধেরউদ্দেশ্য ছিল ইরাক দেশকে নির্মম হিংস্র একনায়কের এক টানা প্রায় আড়াই দশক ধরে মানবরক্ত-পিপাসু সাদামের নির্মমনিপিরণের হাত থেকে উদ্ধার করা আর পূণরুজ্জীবিত করা। কিন্তু আমেরিকানদের পক্ষে সেকাজ সহজ হয়নি। মার্কিণ-বিরোধী বিক্ষুব্ধ সন্ত্রাস দল শহরে ভয়াবহতার সৃষ্টি করেছিল – বোমা নিক্ষেপ, নারী হরণ, শিরচ্ছেদ, খুনখারাপি, ইত্যাদি।শহরের মধ্যে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করা খুবই বিপদজনক ছিল। গাড়িতে যাতায়াতও নিরাপদ ছিল না। যাদের হাঁটারপ্রয়োজন ছিল (তার মধ্যে আমি একজন), তাদের সামরিক পোষাক পড়তে হত।
যুদ্ধ চলাকালীন সাদাম হুসেইন বাগদাদ থেকে পালিয়ে তার নিজস্ব বাড়ির কাছে একটি গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। তাকেখুঁজে বের করতে মার্কিণীদের অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে তাকে এক গর্তের মধ্য থেকে টেনে বের করা হয় – বিনাপ্রতিবাদে। দিনটি ছিল ডিসেম্বর ১৩, ২০০৩। ইরাকের ইতিহাসে এই তারিখটি লাল অক্ষরে লেখা থাকবে।
আমার বাগদাদ থাকা কালীন বিদ্রোহের প্রখরতা ক্রমশ বেড়েছে। সেই কারণে আমেরিকানরাও নিরাপত্তা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তরকরে আর বাগদাদ শহরে তাদের কার্য্যকলাপ কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য “গ্রীন যোন” নাম দিয়ে একটা এলাকা তৈরী করেছে। সাদামের প্রাসাদও এই এলাকার মধ্যেই। আমরা, অর্থাৎ মার্কিণ কর্মচারীরা, প্রাসাদের মধ্যেই কাজ করতাম। থাকারব্যবস্থাও ছিল এই এলাকার মধ্যেই কয়েকটি ভ্রাম্যমান বাড়িতে। বাড়ির ভিতরের আসবাবপত্র খারাপ ছিল না। টিভি ছিল, তাতে CNN Middle East পাওয়া যেতো। গ্রীন যোনের মধ্যে হলেও এসব ক্ষণভংগুর বাড়িগুলি বোমা-বর্ষণ থেকে নিরাপদছিল না, বিশেষ করে রাত্রিবেলা। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই দিনের পর দিন চলেছে দীর্ঘ পাঁচ মাস।
অবশেষে মার্কিণ বাহিনীর হস্তক্ষেপে বিদ্রোহের প্রখরতা অনেকটাই স্তিমিত হল। আবিদ আর আয়েষার বাসস্থান ছিল গ্রীন যোনের বাইরে। কাজে আসার জন্য অনেকগুলো গেইট পার হয়ে ঢুকতে হয়। শুধু তাই নয়, গুলি-গোলাজ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সামরিক পোষাকের দরকার হত। আবিদ এবং আয়েষাও তাইকরত। গেইট থেকে প্রাসাদে পৌঁছনোর রাস্তা বেশ লম্বা। গেইটের বাইরে গ্রীন যোনে ঢুকবার জন্য লম্বা লাইন আর বেকারদেরজটলা। একদমই নিরাপদ জায়গা নয়।
সেদিন আয়েষার আর আবিদের কাজে আসতে দেরী হচ্ছিল। আমি চিন্তিত হলাম কাজের চেয়েও ওদের নিরাপত্তার কথাভেবে। দেরী হচ্ছে দেখে আমার মত দেশী এবং বিদেশী কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করেও কোন সঠিক উত্তর পেলাম না। উচ্চ-পদস্থ এক আমেরিকানকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, জেনে তোমাকে বলব। সারাদিন অপেক্ষা করেও সে কিছু জানাতেপারল না। মানুষ-হরণ এবং শিরচ্ছেদের খবর ক্রমশই বাড়তে থাকল। আমেরিকানদের সংগে যারা কাজ করত তারাইপ্রধান শিকার। নিয়ম মাফিক পরের দিন কাজে গেলাম। অস্বস্তিতে দিন কাটল। আয়েষা-আবিদের কোন খবর নেই পরপর দুদিন।
তৃতীয় দিন। আয়েষাদের বাড়িতে খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল সব দরজা জানলা খোলা। আমেরিকান দল সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজল। ভেতরে কোন লোকজন দেখল না। পাড়া-পর্শীদের কাছ থেকেও সঠিক কোন খবর পাওয়া গেল না। তারা শুধুবলতে পারল আয়েষারা বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে-লুকিয়ে দিন কাটাচ্ছে।
মাসখানেক কেটে গেল। আমার ফিরে আসার দিন ঘনিয়ে আসলে আমার পাশাপাশি যে একজন অষ্ট্রেলিয়ান কাজ করততার ফোন নাম্বার জেনে নিলাম। তার নাম পিটার।
আমেরিকায় ফিরে এসে সপ্তাহখানেক পরে আয়েষাদের কোন খবর পেয়েছে কিনা জানার জন্য পিটারকে ফোন করলাম। সেজানালো:
আয়েষাদের বাড়ির কিছু দূরে ইউফ্রেটিস নদীর পারে এক জংগলের মধ্যে আবিদের মাটিতে লুটিয়ে-থাকা প্রাণহীন দেহটিপাওয়া গেছে। আয়েষাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। চিরতরে হারিয়ে গেল।।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment