পূজোর ইতিহাস কৃষ্ণা চৌধূরী
11th grade এ যখন উঠলাম মাকে বললাম “মা আমার খুব স্বরস্বতী পূজো করতে ইচ্ছে করছে”। “তো ইচ্ছে যখন হয়েছে কর পূজো”, মা বললেন, “ঠাকুর পূজো তো কিছু খারাপ জিনিষ নয়”।
যেমন কথা তেমনি কাজ। ভাইবোনদের মধ্যে একটা হূল্লোড় পড়ে গেল। জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কাকীমা, পিসীমা, মামা, মাসীরাও বাদ গেলনা। বাড়ীর বাইরের ঘরে মাসী, পিসী, দিদিদের ভাল ভাল অথচ একটু পুরোনো বেনারসী, সিল্ক শাড়ী দড়ি দড়া দিয়ে বেঁধে মন্ডপ তৈরী করা হ’ল। বাজার থেকে ঠেলাগাড়ীতে করে ঠাকুর নিয়ে আসা, কাগজের শিকলী আঠা দিয়ে জুড়ে জুড়ে তৈরী করে ঘর সাজানো হ’ল। সে যেন একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল কটা দিন। পাড়ার ঠাকুরের ভোগ রান্নার সঙ্গে সঙ্গে মা কাকীমারা আমাদের ঠাকুরের ভোগও রান্না করলেন। তারপর বিসর্জ্জনের দিন পাড়ার ঠাকুরের লরীতে করে আমাদের ঠাকুরও বিসর্জ্জন গেল।
সেই হল সূত্রপাত আমার স্বরস্বতী পূজোর। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে যখন এদেশে এসে পৌছোলাম তখন পেটের ধান্দায় ঠাকুর পূজো টুজো মাথায় উঠে গেল। তবু যখন শুনলাম Columbia University তে বাঙ্গালীরা স্বরস্বতী পূজো করছে তখন আমরাও সেখানে উপস্থিত হ’লাম। এরপর New Jersey তে 1974 সালের এক সোনাঝরা October মাসের দূপুরে আমার স্বামী দেবু চৌধূরী ও অমিয় সূররায় কোনও এক গাড়ীর dealer এর কাছে গিয়েছিলেন, বাড়ী ফেরার পথে কোনও এক গুজরাটী অনুষ্ঠান দেখে এসেছেন ‘গরবা’ নাচের। বাড়ীতে দুজনেই খুব খোশমেজাজে চা আর সিঙ্গাড়া খেতে খেতে আমাকে সেই গুজরাটিদের ‘গরবা’ নাচের বিবরন দিতে শুরু করলেন। “তা আমরাও তো ওদের মতো একটা কিছু করতে পারি”, বললাম আমি। “হ্যাঁ নিশ্চয়ই”, সায় দিলেন আমার স্বামী।
“আমরা স্বরস্বতী পূজো করলে কেমন হয়”? বললাম আমি। “Good Idea”, লাফ দিয়ে উঠলেন অমিয়দা। ব্যাস্ যেই কথা সেই কাজ। দুজনে লিভিং রুমে বসে তক্ষনি জানাশুনো, পরিচিত এবং অপরিচিত বাঙ্গালীদের নাম phone book থেকে খুঁজে খুঁজে বার করে phone করে করে পূজোর প্রস্তাব রাখতে লাগলেন। সাড়া পাওয়া গেল প্রচুর।
পরের দিন ছিল রবিবার। আমাদের বাড়ীতে মিটিং ডাকা হলো। তখন আমরা যে বাড়ীতে থাকতাম্, জার্সি সিটির সেই one bedroom apartmentএ, পরের দিন লোক সমাগমে ভরে গেল। অবশ্য আমরা দুজনেই যেহেতু হৈ হৈ আড্ডা খুবই ভালবাসতাম্ এবং এখনও বাসি, আর যেহেতু প্রত্যেক weekend এই আমাদের বাড়ীতে আড্ডার আসর বসত তাই লোকজন আসাতে আমাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। ঐ সময়ে অতটুকু apartmentএ আমরা ৫০/৬০ জন মেয়েপুরুষ অতি অনায়াসে আনন্দের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া গল্পগুজব করতাম্ আর এখন দেখি বিরাট বাড়ীতেও জায়গার সঙ্কুলান।
যাই হোক, সেই মিটিংএ জার্সি সিটি এবং আশেপাশের জায়গা থেকে অনেকেই এলেন। এর পরের মিটিংটা ডাকা হলো স্বর্গীয় প্রভাত দত্ত ও শ্রীমতী তনুশ্রী দত্তর বাড়ীতে। জার্সি সিটিতে বসবাসকারী অমিতাভ সেন, অসিত রায়, স্বর্গীয় সত্য রায়, স্বর্গীয় রমেন চক্রবর্ত্তী, দেবাশীষ নন্দী প্রমূখ ব্যাক্তিগন এবং আরও অনেকে পূজোর কাজে লেগে পড়লেন। শঙ্কর ঘোষালের তত্ত্বাবধানে নাটকের rehearsal শুরু হয়ে গেল। অমিয়দা আমাকে বললেন ‘আপনি একটা কিছু করুননা”। “আমার কোনো talent নেই, না জানি নাচতে, না জানি গাইতে, থিয়েটার করারও ক্ষমতা নেই আমার। আমি রান্নার কাজে সাহায্য করতে পারি”, বললাম আমি।
আস্তে আস্তে আরও লোকজন এই পূজোর মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন। অজিত কেশ, বিপুল মুখার্জ্জি, সব্যসাচী গুপ্ত, দীপেন ঘোষ এবং আরও অনেকে যাদের নাম আমার মনে পড়ছেনা আনন্দের সাথে পূজোর কাজে নেমে পড়লেন। সকলের মিলিত উৎসাহ ও উদ্যোগে আমাদের এই অঞ্চলে প্রথম স্বরস্বতী পূজো উদযাপন হলো।
এর দুতিন বছর পরে আমরা ফ্লোরিডা চলে গেলাম। সেখানে প্রথম বছর আমরা Merritt Island নামে যে শহরে থাকতাম সেইখানে আমাদের apartment এর লাগোয়া একটি country clubএ স্বরস্বতী পূজোর অনুষ্ঠান করলাম। ওখানে বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালীরা একসঙ্গেই মেলামেশা করত তাই আমাদের প্রচুর অবাঙ্গালী বন্ধুবান্ধবও এই উৎসবে যোগদান করলেন। সুকুমার ব্যানার্জ্জি নামে যে ভদ্রলোক পৌরহিত্যের ভার নিলেন তিনি ছিলেন আমার স্বামীর বিশেষ বন্ধু।
পরের বছর একটা হল ভাড়া করে পূজো করা হলো। আমরা চলে এসেছি Florida ছেড়ে বহু বছর কিন্তু শুনেছি সেই পূজোই এখন বিরাট বড় হয়েছে। অনেক ঘাটের জল খেয়ে আবার যখন আমরা জার্সিতেই ফিরে এলাম 1981 এর July মাসে তখন আমাদের বাসস্থান ছিল হোপাটকং (Hopatcong) নামে ছোট্ট শহরে। একদিন আমাদের বিশিষ্ঠ বন্ধু অজিত ও ইন্দিরা কেশ জানালেন যে এই অঞ্চলের বাঙ্গালীরা স্বরস্বতী পূজো করবেন, আমরা মিটিংয়ে যেতে রাজী আছি কিনা। আমরা তখন নতুন এসেছি ঐ অঞ্চলে। যেহেতু আমরা লোকজন, আড্ডা প্রচন্ডই ভালবাসি সহজেই রাজী হয়ে গেলাম। মিটিংয়ে গিয়ে অনেকের সাথে আলাপ হলো যেমন অজিত দত্ত, কমল সরকার, হিমাংশু ভট্টাচার্্য্য, দিলীপ গুহ, স্বর্গীয় দেবদাস ঘোষ, নির্ম্মল কুন্ডু, রূপক রাহা, রাম হালদার, স্বর্গীয় রজত মুখার্জ্জি, বিপী মুখার্জ্জি, বিকাশ চ্যাটার্জ্জি এবং সকলের স্ত্রীরা। এনারা সবাই আমাদের মিটিংএ যোগদান করার আগে থেকেই স্বরস্বতী পূজো করার সিদ্ধান্ত নেবার কথা ভাবছিলেন, আমরা এনাদের সঙ্গে জুটে যাবার পরে পুরোপুরি ঠিক্ হয়ে গেল পূজো হবেই। আরও অনেকের নাম হয়তো মনে পড়ছেনা এই মুহূর্ত্তে তবে সকলের সমবেত উৎসাহে 1982 সালে Rockaway, Dover এলাকায় স্বরস্বতী পূজোর অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেই পূজো আজকের দিনে ICCS এর পূজো নামেই New Jersey তে খ্যাত হয়েছে।
এদিকে আমি আজও বাড়ীতে নিয়মিত ভাবে আমার ছোট্ট স্বরস্বতী ঠাকুরপূজো যা কৈশোর বয়সে শুরু করেছিলাম, এখনও সেটা নিয়মিতভাবে করে যাই প্রতি বছর বসন্ত পঞ্চমীতে।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment