Stallions Ghore Fera Split Mind Art by Partha

“গোষ্ঠ ভবন ” – পর্ব ২১ : অন্তর্জলি যাত্রা

Author: Himansu Pal | Posted on: 6th, Apr, 2022

“হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে-
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।”

প্রথম অংশ
“ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”

মৃত্যুকে এর আগে এত কাছ থেকে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি! মৃত্যু যখন মৃত্যুপথযাত্রীর শিয়রে এসে দাঁড়ায় আর প্রত্যেকটা নিমেষে হাতছানি দেয়, মৃত্যুপথযাত্রীর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যমে-মানুষে টানাটানি করে, তখন মায়া কাটাতে হয়। মুখে গঙ্গাজলের ব্যবস্থা করতে হয়। আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে হয়। ছেলে, মেয়ে বা অতি আপনজন কেউ স্পর্শ দিয়ে, কেউ উষ্ণ অনুভূতি দিয়ে, কেউ বা মৃদু-মৃদু ডাকে বোঝাতে চায় তাদের উপস্থিতি। কেউ বা কপালে মাথায় হাত বোলাতে থাকে, কেউ বা ঠাকুমার একটা হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে আলতোভাবে ধরে থাকে। ঠাকুমার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ভাবে প্রকৃতির নিয়ম মেনেই এসেছিল। তাঁর জীবনের পরিপূর্ণতা সাফল্যের মাপকাঠিকেও ছাড়িয়ে গেছিল। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল বিরাশি কি চুরাশি। কিছুদিন আগে বর্ষাকালে পা পিছলে পড়ে যান আর হাত – পা ভেঙে যায়। তারপর আর দাঁড়াতে বা চলাফেরা করতে পারতেন না। খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন। শরীরের ক্ষয় হতে হতে একেবারে নিঃসাড় হয়ে যান। আমাদের ঠাকুমা,

কিশোরীবালা, গোষ্ঠ ভবনের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞীর শেষযাত্রা খুব স্বাভাবিক আর খুব সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়! ঠাকুমা ছিলেন আপাতদৃষ্টিতে খুব জাঁদরেল প্রকৃতির মহিলা। গোষ্ঠ ভবনের কর্তৃত্ব তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় যৌথ পরিবারে বিন্দুমাত্র অনিয়ম হওয়ার জো ছিল না। বড় জ্যাঠাইমা থেকে ছোট কাকিমা, কারো কোনোদিন তাঁর মুখের উপর কথা বলার সাহস ছিল না। ঘরের পিসিকে তিনি একটু বেশিই স্নেহ করতেন, আবার ছোট ছেলে জগন্নাথ বলতেও অজ্ঞান! যদিও চব্বিশ ঘন্টায় একশোচব্বিশবার গদাই-গদাই করতেন! ভাই-বোনের ঝগড়া হলে তিনিই মেটাতেন। প্রত্যেকটা নাতিনাতনির অপরিসীম ভালোবাসা, অপরিমেয় শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন তিনি। পিসিমারাও নিয়মিত তাঁদের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, সঙ্গে পিসতুতো দাদা, দিদি ও ভাইবোনেরা। তখন যেন চাঁদের হাট বসে যেত দিদিমাকে ঘিরে! কারোর দিদিমা, কারোর ঠাকুমা, কারোর মা, কারোর শাশুড়িমা – আজ তাঁর অন্তর্জলি যাত্রা! সবাই এসেছে তাদের শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে।

ঠাকুমার মৃত্যুতে গোষ্ঠ ভবন শোকার্ত হলেও শোক প্রকাশের কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। আমরা ছোটরা, আমাদের খুব কাছের, খুবই প্রিয় আমাদের ঠাকুমাকে হারালাম। বুঝেছিলাম এই শূন্যতা আর পূরণ হবে না। তবুও মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম, – এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সকলকেই একদিন না একদিন মরতে হবে – “অমর কে কোথা কবে”! তাই ঠাকুমার জন্য একটু-আধটু কান্নাকাটি করলেও, একটু-আধটু মন খারাপ করলেও সব মেনে নিয়েছিলাম। তাছাড়া বড়দের খুব একটা কান্নাকাটি করতে দেখিনি। শুধু পিসিমারা কেঁদেছিলেন, খুবই কেঁদেছিলেন বেশ কয়েকদিন। ‘মা’-র মতো পরমাত্মীয় আর কে আছে? সন্তানের ব্যথা বেদনার কথা মা ছাড়া আর কে বুঝবে? এ কথা পাঁচ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে যেমন সত্য, পঁচিশ বছরের কিংবা পঞ্চাশ বছরের মানুষের ক্ষেত্রেও চির

সত্য। মা, মা! মায়ের কোনো বিকল্প হতে পারে না। যদিও মায়ের যন্ত্রণা, কষ্ট দেখে সন্তান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে: “মায়ের দুঃখ কষ্ট লাঘব করো প্রভু, তোমার চরণে আশ্রয় দাও” ।

সেই দিনটা ছিল আর -পাঁচটা দিনের থেকে একটু আলাদা। সকাল থেকেই ঠাকুমার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হতে থাকে। ঠাকুমার ঘর থেকে বেরিয়েই কাকিমা বলাবলি করতে থাকেন; “তোদের ঠাকুমার শরীরটা আজ খুবই খারাপ। ছোট পিসি আর যমুনা পিসিকে খবর পাঠাতে হবে”। আর তখনই ঠাকুমার ঘরে ভিড় লেগে যায়। গোষ্ঠ ভবনের সকলেই ঠাকুমাকে দেখতে আসে। বিকেলের দিকে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়। এইসময় পিসিরা ও দিদিরা অনেকেই চলে আসে ঠাকুমার সঙ্গে শেষ-দেখা করতে। ছেলে-বৌ, মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিদের সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে ঠাকুমার আত্মা শরীর থেকে আলাদা হয়ে রামেশ্বর মন্দির ছুঁয়ে পরলোকের পথে রওনা দেয়। এদিকে কান্নাকাটির রোলের পর্ব শুরু হয় আর তারপর ঠাকুমার মরদেহ নিয়ে শ্মশানযাত্রা শুরু হয়, দ্বারকেশ্বর নদীর পারে।

দ্বিতীয় অংশ

ঠাকুমার মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই গোষ্ঠ ভবনের যৌথ পরিবারেরও অন্তর্জলি যাত্রার সূচনা হয়। ঠাকুমাকে তাঁর জীবনে আরো অনেক শোক সহ্য করতে হয়েছিল। চার ছেলে ও নয় মেয়ের জননী বেশ কয়েকবার নিজের ছেলে-মেয়ের মৃত্যুশয্যার নির্বাক সাক্ষী ছিলেন। জীবিতকালে মাত্র দুই ছেলে ও দুই মেয়ে পাশে ছিলেন। মর্মান্তিক!

একজন মায়ের পক্ষে এতগুলো সন্তানসন্ততির মৃত্যু কতটা মর্মান্তিক হতে পারে একমাত্র সেই মা আর ঈশ্বরই জানেন। গোষ্ঠ ভবনের কাছে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ছিল ঠাকুমার বড় ছেলে, আমাদের বড় জ্যাঠামশায় ঈশ্বর ভাগবত পালের অকালমৃত্যু। তিন নাবালক সন্তানের বাবা ভাগবত পাল মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বড়দার বয়স তখন পাঁচ বছর। তাঁর কোনো স্মৃতিই নেই বড়দার কাছে। গোষ্ঠ ভবনের যৌথ পরিবার প্রথমবারের মতো অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। বড় ছেলের এই আকস্মিক মৃত্যু গোষ্ঠ পাল নিজেও সামলাতে পারেননি। মেজ ছেলে গদাই তখন সদ্য যুবক। সংসারে অনভিজ্ঞ। বড়দার মৃত্যুতে মেজ জ্যাঠামশায় আস্তে আস্তে যৌথ পরিবারের দায়িত্ব বুঝতে শুরু করেন। তার বেশ কয়েকবছর পর গোষ্ঠ পালের মৃত্যু আরো একবার যৌথ পরিবারের মেরুদণ্ডে জোর আঘাত হানে। যৌথ পরিবারের স্নায়ু – ইড়া – পিঙ্গলা সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়, খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ছোট যৌথ পরিবার ততদিনে বিশাল বটগাছের মতো বেড়ে চলেছে। সদস্য-সংখ্যা প্রায় কুড়ি ছাড়িয়েছে। সেজ ছেলে গোবিন্দ যদিও সংসারের দায়িত্ব কিছুটা হলেও নিজ কাঁধে নিতে সক্ষম। ছোট ছেলে জগন্নাথ সবে সরকারি চাকরিতে ব্যস্ত। প্রধান দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন মেজ ছেলে গদাধর। মেজ জ্যাঠামশাই গদাই পাল হলেন যৌথ পরিবারের সর্বময় কর্মকর্তা। এগিয়ে নিয়ে গেলেন গোষ্ঠ ভবনকে। তারপর নানা উত্থানপতনের ঢেউ পেরিয়ে কান্নাহাসির দোলায় গোষ্ঠ ভবন নিজের ইতিহাস লিখে চলে। বড়দা ম্যাথমেটিক্সে মাস্টার ডিগ্রি করে গ্রামেই স্কুলমাস্টারির চাকরি স্বীকার করে, মেজদা ও ছোড়দা গ্রাজুয়েট হয়ে সরকারি চাকরি করেন। বড়দি, মেজদি, সেজদি, সন্ধ্যাদি, মিনাদি একে-একে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে বসবাস শুরু করে। আরো চোদ্দ – পনেরোজন ভাইবোন বড় হচ্ছি গোষ্ঠ ভবনের ছত্রছায়ায়। তার পর হঠাৎ একদিন গোষ্ঠ ভবনের আকাশে ঘোর মেঘ ঘনিয়ে আসে। সেজ ছেলে ঈশ্বর

গোবিন্দ পালের মৃত্যু। গোষ্ঠ ভবন আরো একবার অভিভাবকহীন হয়। কয়েকজন নাবালক ছেলেমেয়ে পিতৃহীন হয়। আমাদের ভাইবোনেদের বয়স কারো চার, কারো চোদ্দ। আমি তখন শিশু শ্রেণীতে সবে স্কুল যেতে শুরু করেছি। বাবার পারলৌকিক কাজকর্মের ভার পড়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র বড় ছেলে সুধাংশুর উপর। মন্ত্রোচ্চারণের সময় বারবার অন্যমনস্ক হয় সে, আর অনন্ত ব্রাহ্মণ সমানে বকাবকি করতে থাকেন। ছেলেমানুষ, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের বিধিবিধান কি বোঝে! আমরা তখন এত ছোট যে, মৃত্যু কাকে বলে তার কোনো অনুভূতি ছিল না। সবাই কেন এত কান্নাকাটি করছে, বাবা কোথায়, সে সব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না। আবছা মনে পড়ে, হাসপাতাল থেকে বাবার দেহ আসার আগে গোষ্ঠ ভবনের সবাই তেঁতুলতলায় কাজল নন্দীদের খামারে জমায়েত হয় আর সবাই উচ্চ স্বরে কান্নাকাটি করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে গ্রামের মনসা কুণ্ডু পেটরোগা ছেলেটাকে ভুলিয়েভালিয়ে নিজেদের ঘরে নিয়ে যায় যাতে বাবার ডেডবডি দেখতে না হয়। তারপর অশৌচ, ঘাট, ন্যাড়া হওয়া, শ্রাদ্ধ, শান্তি সব ঘটনা শিশুর মনে আবছা-আবছা পুরনো দিনের সাদাকালো ভিডিও টেপের মতো রেকর্ড হয়। সেদিন যে কতবড় অঘটন ঘটেছিল, বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিক্ষণে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করে এসেছি। তখনও ঠাকুমা ছিলেন। নাবালক নাতিনাতনিদের মাথার উপর তখনও একটা হালকা ছাদ ছিল। কোনো প্রয়োজন হলে মেজ ছেলে কিংবা ছোট ছেলেকে তিনি আদেশ করতেন। যৌথ পরিবারের অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও আমাদের ঠাকুমা গোষ্ঠ ভবনের যৌথ পরিবারটিকে স্নেহ-ভালোবাসা-আদেশ-শাসন দিয়ে জুড়ে রেখেছিলেন। কোনো কর্তা বা গিন্নি যৌথ পরিবার থেকে সেপারেশনের কথা তুলতে সাহস করতেন না।

কিন্তু ঠাকুমার মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে ওই সব স্নেহ-ভালোবাসা-আদেশ-শাসনের তারগুলো আলগা হতে থাকে আর

একদিন গোষ্ঠ ভবনের যৌথ পরিবারের ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ বাস্তবিক হয়।

Comments »

No comments yet.

RSS feed for comments on this post. TrackBack URL

Leave a comment

What’s new

Our Picture Board

https://usbengalforum.com/ourpictureboard/

https://www.amazon.com/Detour-Incredible-Tales-That-Take/dp/1943190224

Collection of short stories: A book written by Sunil Ghose.

 

p/1943190224Paperback and e-book formats. Please click below:

https://play.google.com/store/books/details?id=zLrHEAAAQBAJ
Editor’s book:
https://www.archwaypublishing.com/en/bookstore/bookdetails/829905-born-in-heaven
Poems – I keep Searching for you, Poems of Twilight Years from Kamal Acharyya.
Short Story:
নারী স্বাধীনতা – Soumi Jana
ঝুমকির ঝমক্ – Krishna Chaudhuri
Variety – মেচ রমনীর দোকনা ফাস্রা – Dr. Shibsankar Pal
সেলাই দিদিমণি, Women help in Carpet making. – Dr Shibsankar Pal.
Arts – Partha Ghosh

Q4-2023 contributors (School and College)
Koushik Dutta
Aniruddha Pal
Srestha Chakraborty

Q1-2024
Arnab Dalui
Deblina Singha Roy

Q3-2024
Saniya Bharti
Anwesha Dey
Neelkantha Saha

Our deep appreciation for many young contributors in all categories.

Quotes

Funniest Quotes about ageing

“First you forget names, then you forget faces, then you forget to pull your zipper up, then you forget to pull your zipper down.”
– *Leo Rosenberg*

HAPPY AGEING AND GROWING

Day's history

15th June

1844 Charles Goodyear patents the vulcanization of rubber
1916 Boeing Model 1, the 1st Boeing product, flies for the 1st time

16th June

1884 1st roller coaster used (Coney Island NY)
1963 Valentina Tereshkova (USSR) is a 1st woman in space, aboard Vostok 6

17th June

1756 Nawab Siraj-Ud-Daulah attacked Calcutta with 50,000 soldiers and captured it on June 21.
1858 Rani Lakshmibai, queen of Jhansi in North India died, one of the leading figures of the Indian rebellion of 1857 (b. 1828)
1944 Iceland declares independence from Denmark

18th June

1898 1st amusement pier opens in Atlantic City, New Jersey
1946 Dr. Ram Manohar Lohia, a Socialist calls for a Direct Action Day against the Portuguese in Goa. A road is named after this date in Panjim

19th June

1963 Valentina Tereshkova 1st woman in space returns to Earth
2008 Barun Sengupta, Bengali journalist died (b. 1934)

20th June

1756 Black Hole of Calcutta: 146 British soldiers, Anglo-Indian soldiers, and Indian civilians are imprisoned in a small dungeon in Calcutta, India where most die from suffocation and heat exhaustion
1756 Siraj Ud-Daulah Nawab of Bengal takes Calcutta from the British

21st June

1906 Vyomeshchandra Banerjee, first president of All India Congress, passed away.
1791 Fleeing French King Louis XVI and family captured at Varennes-en-Argonne
1998 “Home Alone” actor Macaulay Culkin (17) weds broadway actress Rachel Miner (17) in Stone Church in New Preston, Connecticut

 

Day's humor

Week's Horoscope

Horoscope