নিজের বাড়ি জাঁকজমক করে জন্মাষ্টমী উদযাপন করে সুজাতা। বাড়ি মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাইস্টেট অঞ্চলে ওদের গত কয়েক বছরের পাকাপাকি সংসার। এই জায়গায় এত ঘটা করে জন্মাষ্টমী আর কোথাও হয় না। পুজো উপলক্ষ্যে গোটা উইকেন্ড জুড়ে এখানকার বাঙালি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন সুশোভন আর সুজাতার বাড়ি। আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি রাখেনা ওরা।
আজ পুজোর সময় ওদের একমাত্র ছেলে বুবাইয়ের গলায় শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তরশত নামগান শুনে এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ ‘উত্তাল ‘ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সুপ্রিয়া দি তো বলেই দিলেন যে সামনের পুজোয় বুবাই ই করবে ‘দুর্গাবন্দনা’ l সেক্রেটারি পুলক দাও আড়ালে ডেকে সুজাতাকে জানিয়ে দিয়েছেন এবার ‘ উত্তাল ‘ এর কালচারাল কমিটিতে ঢুকছে সুশোভন। আর সুজাতা নিজে তো আছেই নাটকের টিমে গত দু বছর যাবৎ।
যাক বাবা , এত আয়োজন সফল হলো তাহলে ! মনে মনে ভাবে সুজাতা।
জীবনে সবসময় সেরা জিনিসটি পেতে অভ্যস্ত ও। কলকাতা শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে , ছোটবেলা থেকে না চাইতেই পছন্দের জিনিসটি চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। সুশোভনের মতো হীরের টুকরো ছেলেকে বিয়ে করে বিদেশে এসে সেই সুযোগ ও উচ্চাশা আরো দীর্ঘতর হয়েছে। সুখ , স্বাচ্ছন্দ্য , প্রতিপত্তি সবই আজ সুজাতার হাতের মুঠোয়। ইদানীং এখানকার নামকরা বাঙালী সংগঠনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে ওরা। ক্লাবের পরিচালন কমিটিতে একবার ঢুকতে পারলে সম্মান ও ক্ষমতা একলাফে হু হু করে বেড়ে যাবে ! সেইসঙ্গে বুবাইয়ের এক্সপোজার টাও থাকবে বিভিন্ন দিকে । ওর এখন গ্রেড থ্রি চলছে। ছেলেকে গান , আবৃত্তি , পিয়ানো , ক্যারাটে ইত্যাদি নানারকম জিনিস শিখতে পাঠায় ওরা। একটা ক্লাবের সাথে পাকাপাকি যুক্ত থাকলে বছরভর ছেলের এটাওটা অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকবে। সুতরাং সব দিক থেকেই নিশ্চিন্ত। সারাদিনের ক্লান্তির পরও মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে সুজাতার , যেন এক অপরিসীম প্রশান্তি।
মা কে ফোন করে এক্ষুনি সব বলতে হবে , খুব খুশি হবে মা। ফোনটা হাতে নিয়েই চোখে পড়লো মায়ের টেক্সট।
“বাবলি , তোর মনে আছে ঝুমার কথা ? তোর বিয়ের কবছর পরেই বিয়ে হয়েছিল ওর , বরটা ঠাকুর গড়ে কুমোরটুলিতে। ওর বছর ছয়েকের ছেলেটা ফুটপাথে বসে বাবার বানানো গোপাল ঠাকুর বেচছিলো। সেইসময় একজন বিশ্ববিখ্যাত আর্টিস্ট বাচ্চাটাকে দেখে অবাক হয়ে ওর একটা তৈলচিত্র আঁকেন। ছবিটা একটা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। এখানকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখাচ্ছে ঝুমাদের। ওর ছেলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছে ! কলকাতার একটা বড় স্কুল বাচ্চাটাকে বিনা টিউশনে পড়াবে বলেছে। তোকে ছবিটা পাঠালাম। তুইও দেখ , সত্যি যেন দেবশিশু !”
এক ঝটকায় সুজাতার চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রায় ওর সমবয়সী ঝুমার লাজুক রোগা চেহারা। ওর মা বকুল মাসী ঠিকে কাজ করত সুজাতাদের বাড়ি। সুজাতার বাতিল দেওয়া জামা , জুতো , ব্যাগ ইত্যাদি নিয়েই বড় হয়েছে ঝুমা। উচ্ছিষ্ট জিনিস পেয়েই কৃতজ্ঞতার অন্ত থাকতো না মা মেয়ের। গরিবের মেয়ের বিয়েও হয়েছে সেরকম ঘরেই , ভাবলে একটু করুণাই হয় ।
আনমনে ছবিটা খুললো সুজাতা। একটা রোগাসোগা বাচ্চা , রঙ বেশ কালো , ধুলোমাখা গা , চুল উস্কোখুস্কো , ফোকলা দাঁতে হাসছে। শিল্পীর কল্পনায় বাচ্চাটার পরনে গোপাল ঠাকুরের বেশ , কপালে ময়ূরপুচ্ছ , হাতে বাঁশি। ঠিক যেন বালক কৃষ্ণ !
নিজের মধ্যে একটা অস্থিরতা অনুভব করলো সুজাতা , কেউ যেন ওর মনের ভিতর বাড়তে থাকা সুখের ফানুসটাকে পিনের এক খোঁচায় ফুটো করে দিয়েছে। সেই রাতে বস্তিবাসী কাল্পনিক দেবশিশুর একঝলক হাসিতে অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল সুজাতার বহুমূল্য বিদেশী জন্মাষ্টমীর আয়োজন।
সৌমি জানা , নিউ জার্সি
- Gopal
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment