Mon ২রা শ্রাবণ ১৪২৩ / 18.7.2016
১৮ই জুলাই, দুপুর প্রায় দুটো। মার্সেই থেকে বার্সেলোনার দিকে যাচ্ছি। সকাল পৌঁনে ১০টায় গাড়ি ছেড়েছে। প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ। রাস্তায় বার দুয়েক চা, কফি খাওয়া, জল যোগ / বিয়োগ করার সময় ধরে ঘন্টা পাঁচেক লাগবে। ক্রমে সরস মাটি থেকে রুক্ষ মাটির দেশে চলে এলাম। কিছু পরেই ফ্রান্স থেকে স্পেনে ঢুকব। পথে ভুমধ্যসাগর কিছুক্ষণ সঙ্গ দিল, তবে খোলা সমুদ্র নয়, চিল্কা হ্রদের মত মাটি ঘেরা – জলের ওপারে দূরে পাহাড় দেখা যায়। এখন মাটি উত্তর প্রদেশের মত রুক্ষ, ঠান্ডা গাড়ির ভিতরে বসে, রোদ চশমা চোখে দিয়েও মন হচ্ছে বাইরের রোদ যেন ‘আয় মারব, আয় মারব‘ বলে ভয় দেখাচ্ছে। জেনোয়া (এরা বলে, জেনোভা / Genova, নীস / Nice,মোনাকোতে যেমন চোখ ধাঁধান নানা রঙের করবীর ঝাঁক গাছগুলোকে প্রায় নুইয়ে দিয়েছে, এখানে তেমন কিছু নেই। কিছুদূর অন্তর অন্তর লেবু (citrus) ও আঙুরের ছোট বড় ক্ষেত। পাহারা দেবার জন্য ত্রিসীমানায় জনমনিষ্যি নেই। মনে হয়, পরের বাগানের ফল চুরি এখানে তেমন জনপ্রিয় খেলা নয়।
হঠাৎ এ আবার কি হল? Autoroute-এ (ফ্রঁসে Autobahn-কে তাই বলে) সব গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রথামাফিক FM radio-তে ট্রাফিক জ্যামের কারণ নিশ্চয় বলছে। কি খবর জানবার উপায় নেই। বাস শুদ্ধ লোক, মায় স্পেনীয় সারথী,উত্তর ভারতীয় Tour Guide কেউই ফরাসি বোঝে না। সামনে দুই দৈত্যাকার লরী। ওপারে কি হচ্ছে বোঝাবার উপায় নেই। ধৈর্যের পরীক্ষা।
আমাদের সারথী কিছুক্ষণ আগেই ট্যাঙ্কি ভর্ত্তি করেছিল। তাও এতবড় বিশাল coach ঠান্ডা রাখতে কত ডিজেল খেয়ে যাবে জানিনা। সামনের ছোট গাড়ির সোয়ারীরা উপরের জামা খুলে ফেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘামছে। কয়েকটা ছোট গাড়ির মালিক রোদ থেকে গাড়ির রং বাঁচাতে গাড়ির উপর মোটা ঢাকনি পরিয়ে দিলেন। আমাদের গাড়ির যাত্রি ও আশেপাশের অনেক গাড়ির সাহেব পাশের ঢিবির উপর উঠে ছোট বাইরে করে এলেন। কতিপয় মেমসাহেবও ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে বসে এলেন। প্রকৃতির ডাক প্রবল হলে, আপৎকালে সবাই সমান, যত্রতত্র জলত্যাগের জন্য দোষ হয় শুধু ভারতীয়দের। তবু তো ভারতীয় নারীরা আব্রু রক্ষা করে ঝোপ ঝাড়ে যায়নি। Coach-এর স্বল্পব্যবস্থার শৌচালয়ে তাঁরা স্বস্তি পেলেন।
১৮ই জুলাই, বিকেল ৬টা। এখানে সূর্য্যাস্ত হয় সাড়ে নটায়, তাই এখন বিকেলই বলা যায়। অবশেষে ট্রাফিক জ্যাম ছেড়েছে। কারণটা দাবানল। শুকনো ঘাসে আগুন লেগে গাছগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওদিক থেকে দমকলের গাড়ি এসেছে কি না দেখতে পেলাম না, তবে এদিক থেকে প্যাঁ পোঁ শব্দ করে গেল ছটা পুলিশের মোটরসাইকেল,দুটো আপৎকালীন গাড়ি। আকাশে দুটো helicopter আর কিছু পরে দুটো দমকল airplane দুক্ষেপ করে জল ঢেলে গেল। যখন পাশ দিয়ে গেলাম, তখন দেখি দু এক জায়গা থেকে অল্প ধোঁয়া তখনও বেরচ্ছে।
Wed ৪ঠা শ্রাবণ ১৪২৩ / 20.7.2016
সকালে এক পুরুষ্টু প্রাতরাশ খেয়ে এক ৭ ঘন্টা লম্বা যাত্রার তৈরী হচ্ছি। বার্সেলোনার থেকে মাদরিদ যাব। রওনা হবার আগেই একটার পর একটা দুঃসংবাদ। এক বয়স্ক গোয়ানীজ মহিলা Reception-এর সোফায় কাঁধের ব্যাগটা রেখে একবার পিছন ফিরেছেন, ফিরে দেখেন ব্যাগ নেই। একটু আগেই ইংরেজিভাষি একটা বড় মিশ্র দল আমাদের সঙ্গে প্রাতরাশ সেরেছে। দু একটি ছোট পরিবার আর বাকি সব বিভিন্ন বর্ণের অল্পবয়সি মেয়ে। Receptionist-কে জানান হল। শোনা গেল সেখানে security video camera আছে বটে, কিন্তু যে camera-য় কি আছে দেখতে ও দেখাতে পারে,তার কাজে আসার ঢের দেরী। Receptionist মহিলা নানা রকম ভাবে হাত ঘুরিয়ে বোঝালেন, আপাতত তাঁর কিছুই করার নেই। বাস ছাড়তে দেরী হচ্ছে। অগত্যা আমরা গোয়ানীজ পরিবারের নাম ঠিকানা রেখে রওনা হওয়ার জন্য বাসে মালপত্র তুলতে লাগলাম। হঠাৎ এক কর্ণাটকী গিন্নি কাঁদতে লাগলেন। এইমাত্র তাঁর ভাই ফোন করেছে,ব্যাঙ্গালোরে ওনার বাড়ির দরজা ভেঙে ডাকাতে সব লুটে নিয়ে গেছে। পুলিশের কুকুরকে বিভ্রান্ত করতে ডাকাতরা সারা বাড়িতে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে গেছে। আরেকটা ব্যাপার ছোট হলেও বলতে হচ্ছে, সেই কাগজের টুকরোটা খুঁজে পেলাম না, যাতে email id গুলো লিখছিলাম। এক বেন্চিতে বসা হাস্যমুখ সলজ্জ দুই বুড়োবুড়ির ছবি তুলেছিলাম, যারা ইটালীয়ন ছাড়া একটা কথাও বোঝে না। বহু কষ্টে বুড়োর email id-টা যোগাড় করেছিলাম। এক পার্কে আশ্লেষবদ্ধ ব্রোঞ্জ দম্পতির পাশে নববিবাহিত, সদ্য চার্চ থেকে ফেরা এক দম্পতির ছবি তুলে দিলাম, সেটাও পাঠাব বলেছিলাম। সব গেল। তার চেয়েও আক্ষেপের, যে কথার খেলাপ হবে।
TV-তে দেখিয়েছিল বার্সেলোনার থেকে মাদরিদ পর্য্যন্ত এক ধ্যাবরা মেঘ বৃহস্পতিবার সারাদিন থাকবে, তার পর রোদ,তাপ ৪২º উঠবে। আরামেই চলেছি। অল্প খানিকক্ষণ ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি প্রকৃতি অতি বিচিত্র। খানিকটা গেল শান্তিনিকেতনের খোওয়াইর মত। খানিকটা গেল চম্বলের মত। একটা বিস্তীর্ণ এলাকা গেল American wild west-র মত দেখতে। পৃথিবীটা বলছে, আমাকে দেখ, আমিই সব, আমি আমারই মতন, এবার তোমাদের তুচ্ছ পাড়াতুত ঝগড়া, মারামারি বন্ধ কর, তোমরা কিছুই নও।
মাটির কত রকমের রং, কোথাও মেটে, কোথাও ছাই, কোথাও একেবারে খড়িমাটির মত সাদা। সব মাটিতেই চাষ হয়। এক যায়গায় এক শীর্ণকায়া, স্বল্পতোয়া নদী দেখলাম, তার পর বহুদূর পর্য্যন্ত আর কোন জল দেখলাম না। অথচ কোন কোন মাঠে চক্রারুঢ় মাছের কাঁটার মত বকযন্ত্র দেখলাম। তার থেকে ফোয়ারার মত তোড়ে জল বেরিয়ে মাঠ সিঞ্চন হচ্ছে। বাস আস্তে আস্তে উঁচুতে চড়ছে। শুকনো মাটি ক্রমে সরস হল। কিছু উঁচুতে মাটিতে সবুজের উন্মেষ হল। কয়েকটা মাঠ পরে চারা গজিয়েছে, বোঝা গেল এসব ভুট্টার ক্ষেত।
ঝোপের মধ্যে কয়েকটা জনহীন ভাঙ্গা বাড়ি, কম করে ১০০ বছর বয়স। আরও উঁচুতে উঠছি। হঠাৎ এক টুকরো অতিপ্রাচীন দেওয়াল, কোথাও পাললিক শীলার পাহাড়। শীলার সব স্তর সমান্তরাল। স্তরগুলোর মধ্যে কোনটা দুর্বল,সেগুলো জলে, হাওয়ায় ক্ষয় হয়ে গেছে। স্তরগুলোর মধ্যে যেগুলো সবল, সেগুলো রয়ে গেছে। তাই পুরো পাহড়গুলোই রেখাটানা পাথরের মত। তার মধ্যে কিছু শীর্ণ পথরেখা।
Thu ৫ই শ্রাবণ ১৪২৩ / 21.7.2016
আজকাল এক উটকো উৎপাত হয়েছে যা আগে ছিল না। যাত্রাপথে বিমান বদল হলেও নতুন করে নিরাপত্তা পরিদর্শন হবে। আরে আমি কি একবার মাদরিদে নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে এসে দুবাইতে বিমান বদল করতে নেমে হাওয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেড়ে আনছি নাকি? সময় কম, নতুন বিমানের দরজায় যেতে গেলে রেলগাড়িতে চাপতে হয়। ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটলাম। নানা ফ্যাচাং – ঘড়ি, পয়সার ব্যাগ সব কিটব্যাগে ঢোকাও, বেল্ট খুলে ব্যাগের সঙ্গে ডালায় রাখ, iPad আলাদা ডালায় রাখ। গিন্নির হাতের চুড়ি বালা সহজে খোলে না বলে অন্যান্য সব বিমানবন্দরে ছাড় পাওয়া গিয়েছিল, এখানে ভারতীয় নারীকে হেনস্থা করার সুযোগ পেয়ে ভাড়াটে পাকিস্তানি পেয়াদা কিছুতেই ছাড়ল না। টেনে খুলতে গিয়ে হাত ছড়ে রক্তারক্তি।
যা হোক করে বিমানে তো এসে বসা গেল। খিদে পেয়ে গেছে। খাবার এসে পৌঁছাল, খুলে দেখি নিরামিষ ‘Hindu Meal’। গন্ডগোলটা সম্ভবত পাকিয়েছে আমাদের Travel Agent. ফলের টুকরোগুলো খেয়ে বাকি সব ফেরৎ দিয়ে দিলাম। বিমানের পিছনদিকে কিঞ্চিৎ উচ্চকন্ঠে কথোপকথন। মনে হল, আমাদের আমিষ থালা দুটো আমাদেরই দলের সহযাত্রী কট্টর নিরামিষভোজি কর্ণাটকী পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। বলে কয়ে দুবাই – কলকাতা অংশের যাত্রায় Standard Meal-এর ব্যবস্থা করলাম। খুব একটা লাভ হলনা। ইউরোপের উপর যাবার সময় যত ভাল খেতে দেয়, ভারতযাত্রা অংশে তত ভাল দেয় না।
দুবাই – কলকাতা অংশে আরবী, ইংরেজী আর বাংলা, এই তিন ভাষায় বিমানবাণী হয়। যথাকালে ভারতের আকাশে পৌঁছালাম। ইতিমধ্যে সকাল হয়ে গেছে। বিমান নিম্নমুখী হবার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবালা জানালেন শুভেচ্ছা – না সুপ্রভাত নয়, “শুভ সকাল”। ভুল শুনিনি, কারণ দুবার শুনেছি। সবসমেৎ ১২ ঘন্টার উপরে এক রকম আসনে বসে থেকে, না ঘুমিয়ে, শেষে ঐ বিচিত্র বাংলা শুনে শরীরে ও মনে বিদ্ধস্ত হয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম।
ভাবছি আর কোনোদিন যদি সুদূর বিদেশ যাবার সুযোগ হয় তবে সেই জায়গাতেই যাব, যেখানে সরাসরি উড়ান যায়,মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ করতে হয় না।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment