মহাষষ্ঠী থেকে বিসর্জন—দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতার সবখানেই ঢাকের বাজনা চাই-ই চাই। এরই মধ্যে সর্বত্র রটে গেছে আনন্দময়ী দুর্গার আগমনবার্তা। মণ্ডপ সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পূজারিরা। পূজার আনুষ্ঠানিকতার প্রধান অনুষঙ্গ ঢাকের চাহিদা মেটাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রতিবছরের মতো এবারও বসেছে ‘ঢাকের হাট’। ঢাক বাজানোর মুন্সিয়ানা দেখে যে হাট থেকে ঢাকিদল ভাড়া করে নিয়ে যান পূজার আয়োজকেরা।
গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে কটিয়াদীর পুরানবাজারে সরেজমিন ঢাকের হাটে গিয়ে দেখা যায়, দূরদূরান্ত থেকে ঢাকিদের অসংখ্য দল হাটে এসেছে। ঢাকঢোল আর বাঁশি বাজিয়ে পূজার আয়োজকদের নজর কাড়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। অনেকে আবার বায়নার জন্য দরদাম করছেন। সেনাসদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাজার পরিদর্শন করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার হাটে এসেছে প্রায় দুই শ ঢাক দল। দুই শ দলে সদস্যের সংখ্যা অন্তত এক হাজার। নানা কারণে আগের জৌলুশ হারাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই হাট।
দুর্গাপূজায় কটিয়াদীর ঢাকের হাটকে হৃদয়ে লালন করেন ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে আসা পূজারি অবিনাশ দেবনাথ। হাটে তাঁর ৪০ বছরের আসা–যাওয়া। হাটে এসে দরদাম করে ঢাকদল না নিয়ে গেলে মন ভরে না। এবারও তিনি এসেছেন। অবিনাশ বলেন, দিন দিন হাটে অসুবিধা বাড়ছে। এইভাবে অসুবিধা বাড়তে থাকলে ঐতিহ্যের হাট স্মৃতি হয়ে উঠবে। বাস্তবে আর খোঁজে পাওয়া যাবে না। হাটের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করা উচিত।
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তাঁর রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকিদল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন ও পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তী সময়ে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে। এখনো হাট বসে সেখানে।
স্থানীয় লোকজন জানান, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, হবিগঞ্জ থেকে হাটে ঢাকের দল আসে বেশি। শুরুর রীতি অনুযায়ী এখনো হাটে ঢাকিরা পূজারির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সমবেতভাবে বাজনা বাজান। বাজনায় যে দলের যত মুন্সিয়ানা, পূজারির কাছে তাদের কদর তত বেশি। এবার হাট বসেছে গত সোমবার থেকে। গতকাল বুধবার ছিল শেষ দিন।
ঢাকার বিক্রমপুর থেকে ৩৫ সদস্যের দল নিয়ে মঙ্গলবার কটিয়াদীর ঢাকের হাটে আসেন শম্ভু দাস। তিনি দলের প্রধান। ৩৫ সদস্য দিয়ে ৫টি ঢাকদল গঠন করেন তিনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবল তাঁর একটি দল মণ্ডপ পায়। অন্য চারটি দল নিয়ে তাঁকে হাটে রাত যাপন করতে হবে। এই নিয়ে শম্ভুর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। শম্ভু দাস বলেন, দুর্গাপূজা এলেই কটিয়াদীর হাট মনকে টোকা দেয়। কত স্মৃতি! ফলে না এসে মন মানানো যায় না। আবার এসেও পদে পদে দুর্ভোগ। থাকা-খাওয়ার সমস্যা বড়। বিশ্রাম নিতে সমস্যা। অভাব আছে শৌচাগারের। এত দীর্ঘ সময় সাধারণ সমস্যাগুলো সমাধান না হওয়ায় আফসোসের সঙ্গে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি।
টাকা কত পেলাম, সেটা বড় কথা নয়, চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছি এতেই শান্তি।
ঢাকি ও হাটের আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা হাটের ঐতিহ্যে বড় আঘাত হেনেছে। এখন পূজারিরা আর হাটে এসে দরদাম করে ঢাকিদল নির্বাচন করতে আগ্রহী নন। তাঁরা ঢাকিদলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। মুঠোফোনেই দরদাম করে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পড়েন। আর বায়নার টাকাও পৌঁছে যায় মুঠোফোনে। এ কারণে প্রতিবছর হাটের কদর ও জৌলুশ—দুই কমছে। তবে প্রযুক্তির যুগে এসেও এখনো অনেকে দূর থেকে হাটে এসে দরদাম করে ঢাক দল নির্বাচন করতেই যেন পছন্দ।
ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে সোমবার হাটে এসেছিলেন সুশীল দাস। তিনি একটি মণ্ডপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছেন। এই জন্য স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘টাকা কত পেলাম, সেটা বড় কথা নয়, চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছি এতেই শান্তি। কারণ, তা না হলে থাকতে হতো হাটে। সেই ক্ষেত্রে কষ্ট হতো অনেক।’ বিশুদ্ধ পানির সমস্যা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।
হাটের সমস্যার কথা অজানা নয় কটিয়াদী উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ধ্রুব রঞ্জন দাসের। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে ঢাকের একমাত্র হাট কটিয়াদীর এই হাট। অথচ এখনো আমরা শৌচাগার ও বিশ্রামাগারের সমস্য দূর করতে পারলাম না।’
ঢাক বাজার কমিটির সভাপতি শীতল সাহা বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে হাটে এখনো প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন শ ঢাকির দল আসে। এবার কিছুটা কম এসেছে। বায়না না হওয়ায় অনেককে ফিরে যেতে হয়। সেই ক্ষেত্রে তাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁদের ক্ষতিপূরণের জন্য ফিরে যাওয়ার ভাড়া ও খাওয়ার টাকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে সমাধান বের করা গেলে হাটটি টিকে থাকবে। না হলে প্রযুক্তির যুগে ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন।
ঢাক দলের সদস্যদের সমস্যার কথা জানেন উল্লেখ করে কটিয়াদী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, কীভাবে ঢাকিদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায়, সেই ব্যাপারে চিন্তা করা হচ্ছে।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment