শ্রীচরণেষু মা,
আশ্বিন পড়ে গেল, আকাশের নীলে হালকা মেঘ ভাসছে, মাঠের কাশফুলগুলো হাওয়ায় দুলতে শুরু করেছে। শহর-শহরতলী-গ্রাম ছাড়িয়ে দেশ-দেশান্তরের মানুষের মনে ঢাকের মৃদু আওয়াজ ভাসছে, সকালগুলো যেন বলছে তুমি আসছ, আমাদের মা আসছে। বছরের পর বছর তুমি আসো তবু এ তো মাত্র একটা বছর নয়, যেন একটা যুগের অপেক্ষা – সেই যুগের শেষ হল বলে। দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রনা, রাগ-তাপের কিছু দিনের জন্য হলেও নিষ্পত্তি। ক্ষণিকের জন্য হলেও খুশী-আনন্দ-কোলাহলে ছেয়ে যায় ক’টা দিন কারণ মা আসছে। আমাদের ছোটোবেলায়, যখন গরীবের সংখ্যাটা চোখে পড়ার মত ছিল, এক অতি গরীব মা তোমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল – মা তোমার পুজোর দিনগুলোয়ও নিজের ছোটো ছেলেমেয়েগুলো প্রায় ন্যাংটো হয়ে থাকে আর শয়ে-শয়ে মানুষ কত রকমের নতুন জামাকাপড় পরে তোমায় প্যান্ডলে দেখতে যায় – এ দেখতে বড্ড কষ্ট হয়, তাই বলি তুমি প্রত্যেক বছর না এসে পাঁচ বছর বাদে-বাদে এসো, দুঃখটা প্রত্যেক বছর সইতে হয় না। তবু তুমি আসো, প্রত্যেক বছর। আজ গরীব-বড়লোক প্রায় সবার মুখেই তুমি ক’দিনের জন্য হলেও হাসি-খুশী-আনন্দ বা আশা ফুটিয়ে তুমি আসো।পুজোর দিনগুলোয় আলোর রোশনাইতে মানুষের দুঃখ প্রায় চোখেই পড়ে না আজ । সাবেকী পুজো থেকে থিম্ পুজো, প্যান্ডলে-প্যান্ডলে গরীব-বড়লোক, বাঙালী-অবাঙালী, শহর, গ্রাম, দেশ, বিদেশ সব জায়গায় ভীড় – পুজো তো নয়, এ তো উৎসব। লক্ষ মানুষ কত হাজার কোটির ব্যবসা করার সুযোগ পায় – সে তো তোমাকে ঘিরেই। আবার এমন ক’টা দিনের অপেক্ষা!
তবে মা, এ ছবি বেশ পুরোনো। বড্ড চেনা, একটু একঘেয়েও। এবার কিন্তু তোমার আগমনী একেবারে অন্য ভাবে গাওয়া – একদম অন্য সুরে, অনন্য ছন্দে, অকল্পনীয় ভাবে বাস্তব। এ আগমনী কল্পনার রং-য়ে চোবানো নয় বরং আবেগ-মনুষ্যত্ব-বিবেকে বাঁধা, দেবী দুর্গার মানবী রূপের আগমন। কোনো আকাশ পথে বা জলপথে আগমন নয় – শহর কলকাতা, শহরতলী থেকে পাহাড়, বাংলা থেকে সারা দেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তায় দলে-দলে লাখে-লাখে দেবীর আগমন। স্বর্গ থেকে কারুর মর্ত্যে আসা নয়, নিজের ঘর-বাড়ী থেকে লক্ষ-লক্ষ মানুষের রাস্তায় নামা – সাধারণ মানুষের ভীড়, জাত-পাত-লিঙ্গ-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে পুজোর আগেই পুজোর ভীড়। দেবত্ব থেকে পশুত্ব যে এই মানুষেরই বিভিন্ন স্তর তার প্রমাণ এই ভীড়। জল-কাদা-ঘামে-ভরা বাস্তবের এই পৃথিবীই যে স্বর্গ,মর্ত্য বা পাতাল সব হতে পারে, এই ভীড়ের মানুষের বিবেকের তাড়না তাকে প্রমাণ করে।
এক তিলোত্তমার নৃশংস মৃত্যু যেখানে একদল মানুষরূপী পাশবিক অসুরকে আমাদের সামনে হাজির করে, যার মধ্যে অনেকেই হয়ত আজও মুখ লুকিয়ে আছে, সেখানেই মা, হাজির হয়েছে কত লক্ষ-শত দুর্গা।। রাত দখল করার দাবী নিয়ে স্বাধীনতার দিনে স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার, শহর কলকাতা বা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কোণ থেকে, মানবিকার তাড়নায়, ন্যায়ের দাবীতে, কত-শত সাধারণ মেয়ের শক্তির অসাধারণ প্রকাশ। ৮০ বছরের শ্রীমতী রেণুকা দাস অসুস্থ শরীরে যখন বেলেঘাটার মোড়ে মানুষের মিছিলে প্রতিবাদে সামিল, সে তো মা তোমারই প্রকাশ। চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল আর মহামেডান দল যখন একসাথে, এক প্রতিবাদে সামিল সে তো মা ভ্রাতৃত্বের আর মিলনের দুর্লভ বাস্তব ছবি। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের, বা বিভিন্ন পেশার মানুষদের, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বয়স নির্বিশেষে, ন্যায্য বিচারের দাবীতে মানুষের যে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মিছিলে পা মেলানো আর দিনের পর দিন সেই আবেগ-রাগ-বিরক্তির প্রকাশ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অসুরদের শাস্তীর দাবীতে,তাদের মুখোশ খোলাতে, সে মানুষের দৈবী প্রকাশ ছাড়া আর কি! যখন দিনের পর দিন মানুষের এমন মানবিকতার মিছিল দেখছি তখন মনে হচ্ছে মা তোমারই শক্তির বিচ্ছুরণ হচ্ছে, তোমারই পুজোর আগমনী হচ্ছে। যখন এক সাধারণ ফল বিক্রেতা মিছিলে-সামিল ডাক্তার ভাই-বোনেদের জন্য এক বস্তা শশা বিনা পয়সায় দিয়ে যায় বা যখন এক মা তার বাড়ীর ফোন নম্বর দিয়ে যায় যাতে রাত-জাগা ছেলেমেয়েরা যেকোনো সময় তার বাড়ীর বাথরুম বা ঘর ব্যবহার করতে পারে তখন যেন আসল ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় রোজকার জীবনে। আমি শুনতে পাচ্ছি
“যদা যদা হি ধর্মস্য
গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানামধর্মস্য
তদাত্মনং সৃজামহ্যম্।।
পরিত্রানায় সাধূনাং
বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায়
সম্ভবামি যুগে যুগে।।“
যখন শাসকের আক্রমণ, শাসানি বা রক্তচক্ষুকে ভয় না পেয়ে, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে জুনিয়র ডাক্তাররা সুবিচারের দাবীতে অনড়, তখন মা মনে হচ্ছে আমি শুনছি এক পুরোহিত তোমাকে সামনে রেখে মন্ত্র উচ্চরণ করছে “রূপং দেহী, জয়ং দেহী, যশো দেহী, দ্বিষো জহি”।
জন্মের পর থেকে এমনভাবে পুজোর আগমনী কোনোদিন দেখিনি। কোটি টাকার প্যান্ডেল, চোখ ধাঁধানো আলো বা বিভিন্ন প্যান্ডেলে তোমার মূর্তির শৈল্পিক নিদর্শণ এবার যেন ফিকে পড়ে গেছে। পুজোর আগে মানুষের এমন অনন্য প্রতিবাদ, বা সাম্প্রতিক বাংলার বন্যা, কিছু মানুষের হয়ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুঃখের কারণ হয়েছে কিন্তু যে সুবিশাল মানবিকতার প্রকাশ অসংখ্য সাধারণ মানুষ অসাধারণভাবে ঘটিয়েছে – এমন শক্তির , নারীশক্তির প্রকাশ বা অশুভ শক্তির বিনাশ আর শুভ শক্তির উদয় হবার প্রচেষ্টা তা মানুষ এমনভাবে ক’বার দেখেছে। বৃহত্তর সামাজিক বা মানবিক উদ্দ্যেশ্যে কিছু মানুষের ত্যাগ তো অবশ্যম্ভাবী। ছবিতে-মন্দিরে-প্যান্ডলে ঠাকুর প্রণাম করে লোকদেখানো মিথ্যা ভক্তি না দেখিয়ে সমাজের বা মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে তোমার শুভ শক্তির এমন প্রতিচ্ছবি তো তোমার পুজোরই সার্থকতা। তোমার আগমনী এর থেকে আর কি ভালোভাবে হতে পারে মা!
তিলোত্তমার এমন নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন পৃথিবীর কোথাও আর না ঘটে। তবে তিলোত্তমা যে অসংখ্য মানুষের মানবিকতাকে জাগিয়ে দিয়ে, এক সুরে বেঁধে দিল এতে যেন এক এবং অদ্বিতীয় সূক্ষ্ম আত্মার এক নিদর্শণ পাই। এর জন্য তোমার পূজোর বাহ্যিক অনুষ্ঠানে, আড়ম্বরে একটু খামতি হলেও ক্ষতি কি মা! পুজো তো আড়ম্বরে নয়, ভক্তিতে ; পুজো তো কেবল মাটির প্রতিমা-কে নিয়ে অং-বং-ঢং নয় বরং তোমাকে স্মরণ করে মানুষের মধ্যে শুভ বুদ্ধির জাগরণে । এমন ভাবে পুজো হলে তুমি শুধু আশ্বিনে কেন, যে কোনো মাসে এসো, প্যান্ডলে নয় এমনভাবে রাস্তায় বা মানুষের মনে এসো, কৃত্রিম আলোর রোশনাইতে নয় মানুষের বিবেকের, বিচারের আলোয় আলোকিত হয়ে এসো মা। তোমার দৈবী-কাল্পনিক-মাটির রূপেই কেন, রক্ত মাংসের শরীরে মানবী হয়েই এসো মা।
আর একটা কথা, দেবতাদের সংখ্যা যেমন কম নয়, সমাজে অসুরের সংখ্যাও প্রচুর আর তাদের হাতও অনেক লম্বা, তাই তুমি যেখানেই থাকো সাবধানে থেকো মা! ভালো থেকো
— তোমার এক সন্তান
সুমন কুমার চন্দ্র
Nice. Yes, we need Ma Durga’s physical appearance to the World.
Comment by dchaudhuri — October 8, 2024 @ 10:10 pm