“বাবু আট আনা হবে?” বাস স্টপে একটা ছ’সাত বছরের বাচ্চা ছেলের ডাকে হঠাৎ পেছন ফিরে তাকালাম। রুগ্ন চেহারা। দেখে বোঝা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন স্নানও করেনি। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে জানান দিচ্ছিল তার গরীবি। কথা চালানর জন্যই মনে হল একটু বাজিয়ে দেখি।
বললাম, “আট আনাতে কি হবে রে?”
“আমি জানিনা। বাবা চাইতে বলল”
“বাবা কোথায় তোর?”
“ওই গলির ভেতর”
“তা বাবা নিজেই না এসে তোকে পাঠাল?”
“বাবার যে শরীর খুব খারাপ। উঠতেই পারছেনা”
কি মনে হল ছেলেটার পেছন পেছন চলে এলাম গলির ভেতর। যেমনটা ভেবেছিলাম তার থেকেও হাড় জিরজিরে একটা লোক হাড় পাঁজরা বার করা শরীরে আধশোয়া হয়ে ধুঁকছে। দেখে মনে হল আর বোধহয় পরমায়ু বেশি নেই এর।”বাবু, বাবু” বলে খুব সম্ভবত: আমাকে ডাকতে চাইল কিন্তু গলার আওয়াজ খুবই ক্ষীণ। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তোমার এই অবস্থা এর মধ্যে ছেলেকে ভিক্ষে করতে পাঠিয়েছ তাও শুধু আট আনা পয়সার জন্য। লোকটা চিঁ চিঁ করে যা বলল তার মর্মার্থ হল গত দুদিন আগে ভিক্ষের রোজগারের চার টাকায় ইচ্ছে হয়েছিল মরার আগে বাপ ব্যাটা দুজনে মিলে সামনের লছমনের দোকান থেকে রুটি আর ডাল কিনে খাবে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখে তার দাম সাড়ে চার টাকা। অনেক হাতে পায়ে ধরে আট আনা ধার রেখে সেই রুটি ডাল খেয়েছে কিন্তু তার ধার মেটানোর জন্য অচল, অকর্মণ্য বাপ পাঠিয়েছে তার ছেলেকে ভিক্ষে করে সেই দোকানদারের থেকে ঋণমুক্ত হতে। নিজের মৃত্যু অনিবার্য তাই নিজের পেটের জন্য কিছু না জুটুক মৃত্যুর আগে কোন ঋণের বোঝা রাখবে না সেই অভিপ্রায়ে ছেলেকে ভিক্ষায় এগিয়ে দেয়া। ছেলেটার কচি মুখটা দেখে মনে মনে ভেবেই রেখেছিলাম পকেটে যা আছে তাই দিয়ে সাহায্য করব। হাত ভরে কুড়ি পঁচিশ টাকার মত যা উঠল ছেলেটাকে দিয়ে দিলাম। ছেলেটা শুয়ে থাকা বাবার সামনে রাখা অ্যালুমিনিয়মের বাটিতে সেটা রাখতেই দেখলাম লোকটা ততক্ষণে ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। চোখের কোণে মনে হল একটু জল। সেটা কষ্টের না মনোকষ্ট লাঘবের, বোঝা গেলনা।
***
কয়েকদশক আগে ছোট্টবেলায় একবার দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে যাবার সময় বালির মোড়ে এক সর্দারজি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে চেঁচিয়ে বলতে শুনেছিলাম, “মরে যাবে আট আনা, মরে যাবে আট আনা।” খুব কৌতূহলের স্বরে মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মা, ওই সর্দারজি লোকেদের মেরে ফেলার জন্য চিৎকার করে ডাকছেই বা কেন আর তার জন্য আট আনা পয়সাই বা চাইছে কেন?”
মা খানিক খুব হেসে নিয়ে বলেছিলেন, “ধুর বোকা, ও কাউকে মারতে যাবে কেন? শেয়ার ট্যাক্সিতে করে মাথাপিছু আট আনায় মোড় অবধি নিয়ে যাবে তাই প্যাসেঞ্জার চাইছে। ওর অবাঙালী উচ্চারণে “মোড়ে যাবে” কথাটা “মরে যাবে” হয়ে গেছে।”
না জানি কেন আজ হঠাৎ সেই কথা মনে পড়ে গেল। মনে হল লছমনের ধার শোধের আট আনাই হয়ত সেই ভিখিরির শেষ পারানির কড়ি ছিল।
দুঃখজনক
Comment by debu — March 18, 2024 @ 10:13 pm
Nice short story from Ranjan. Hope to see more from him. Thanks Debu for the forward
Comment by Subal sarkar — March 24, 2024 @ 1:55 pm