প্রায় দু’ বছর বাদে এ বছরের দুর্গা পুজোয় ছেলে আর বৌমা বাড়ি ফিরছে – কথাটা ভেবেই আনন্দ যেন আর ধরে না সুমিতা দেবীর। বাড়ির পুজো বলে কথা একা সব সামলাতে পারে নাকি একটা বয়ষ্ক মানুষ? এইবার ওরা আসছে ওদের হাতে সব দায়িত্ব দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে মুক্তির স্বাদ নেবেন উনি।আবদার করে ওদের বলবেন যাতে আর ওরা বিদেশে না ফিরে যায়,এখানেই যেন থেকে যায় ওনার সাথে।
এই সবই ভাবছিলেন এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে,অপরপ্রান্তে তার ছেলের কণ্ঠ, প্রচণ্ড আতঙ্কের সঙ্গে ছেলে তাকে বললো “এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকেই এগোচ্ছিলাম কিন্তু হঠাৎ গাড়িটা ব্রেকফেল হয়ে যাওয়াতে একটা বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে”। ছেলে আর বৌমার দুর্ঘটনার কথা শুনে কোনো মতে ছুটে গেলেন তাদের কাছে।হাসপাতালের নামটা অবশ্য আগেই শুনে নিয়েছিলেন ফোনে তে।
ওখানে পৌঁছে দেখলেন ছেলে আর বৌমার খুব একটা ক্ষতি হয়নি,তবে ফুটপাতে থাকা কিছু মানুষের বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে।একটা ফুটফুটে বাচ্ছা মেয়ে আজ অনাথ হয়েছে ওদের জন্যেই। বাচ্ছা মেয়েটির মুখটায় চোখ পড়তেই সুমিতা দেবীর ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। সেই চেনা মুখ, হাতের সেই আঁচিল। এই মুখ তার ভোলার নয়। তবে এইবার আর না। আবার তিনি এক ভুল করবেন না। কারোর মাতৃত্ব কেড়ে নেওয়ার অধিকার তার নেই,সেটা তিনি এখন ভালোই বুঝেছেন। বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলেন সুমিতা দেবী এবং ছেলে ও বৌমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বাচ্চাটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন ও অনাথ নয়, ও আমাদের পরিবারের নতুন সদস্য তোমাদের মেয়ে আর আমার নাতনি”।
ওদেরকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সুমিতা দেবীর মনে পড়ে যাচ্ছিল দু’বছর আগের সেই মহালয়ার দিনের কথা। যেদিন বৌমার কোল আলো করে দেবীপক্ষেই আগমন ঘটে এই ছোট্ট দুর্গা-র। কিন্তু ছেলের প্রথম সন্তান তাও আবার মেয়ে, তা দুর্গা সেবিকা সুমিতা দেবীও সেদিন মেনে নিতে পারেননি। তাই সবার চোখের আড়ালে ফুটপাতের ধারে ফেলে এসেছিলেন বাচ্ছাটিকে। কিন্তু মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে শোনার পর থেকে তার বৌমা দিন দিন কেমন জানি অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। সেই সব দৃশ্য দেখে নিজেকেই বহুবার দোষারোপ করেছেন তিনি , এমনকী নিজের চোখে নিজেকে খুব ছোটোও মনে হয়েছিল তার। তাই বোধ হয় পাপ বোধ থেকে মুক্তি পেতেই ফেলে আসা সেই সন্তানকে খোঁজার চেষ্টাও করেছিলেন খুব। কিন্তু ভগবানও হয়তো সুমিতা দেবীকে ক্ষমা করতে পারেননি তখনও, তাই তার এই ছোটো মানসিকতার জন্যে আর ভাগ্যের পরিহাসে দেবীপক্ষে আগত সেই ছোট্ট দুর্গা আর তখন দেখাও দেয়নি ওনাকে। “কিন্তু আবার যখন পেয়েছি মা গো,আর কী তোমাকে ছাড়ি ? আদর করে তোমার সব অভিমান ভুলিয়ে দেবো” কথাগুলো বিড়বিড় করতে লাগলেন সুমিতা দেবী।
সব রকম ডাক্তারি পরীক্ষা – নিরীক্ষা করিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেলো। ষষ্ঠীর সকাল মা দুর্গার বোধনের কাজ চলছে বাড়ির উঠানে, এমন সময় বাড়ির সবাইকে কিছুটা চমকে দিয়েই সুমিতা দেবী ঠাকুরের বরণডালা দিয়ে বরণ করে নিলেন বাড়ির ছোট্ট দুর্গা কে।
মনে মনে বললেন ,” কোনো এক মহালয়াতে তুমি এসেছিলে। কিন্তু আমার পাপী মন মূর্তিপূজার বিশ্বাসী হলেও জ্যান্ত দুর্গাকে বরণ করতে লজ্জা পেয়েছি। তবে আজ আমার কোনো লজ্জা নেই এটা জানাতে যে আমি আমার বাড়ির ছোট্ট দুর্গারও বোধন করলাম অনেকটা ভালোবাসা দিয়ে।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সত্যিই যেন এই বাড়ির দুর্গা মূর্তিও আজ ফিরে পেলো তার প্রাণ।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment