বিগত কয়েক দশকে নিউ ইয়র্ক শহর এবং শহরতলীতে আরও অনেক বাঙালীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, দুর্গাপূজার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে Brooklyn এবং Bronx এ। এমনিতেই নানাবিধ সুবিধার জন্য বহু বাঙালির বাসস্থান হয়েছে নিউ ইয়র্ক শহর ও শহরতলীতে।। নিউ ইয়র্ক শহরের লাগোয়া Connecticut আর New Jersey স্টেটেও বহু বাঙালির সমাবেশ হয়েছে। আর একদিন এখানেই সম্মিলিতভাবে বাঙালিরা গড়ে তুলেছিল তাদের নিজস্ব বিভিন্ন এসোসিয়েসন।আর এদের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল দুর্গাপূজা। শুনলে অবাক হতে হয় যে এ বছর নিউ ইয়র্ক শহর ও শহরতলীতে চল্লিশটারও বেশী দুর্গাপূজা হচ্ছে।
হঠাৎ এতগুলি পূজা এল কোত্থেকে, তবে কি বাঙালীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল? ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। আসল কারণটা হচ্ছে, কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ, কোন একজন কর্মকর্তার সাথে আরেকজন কর্মকর্তার মতভেদ হল, সাথে সাথে সে আরেকটা নতুন পূজার ঘোষণা করে দিল। জার্সিসিটির দুর্গাপুজা সম্ভবতঃ নিউ জার্সির প্রথম দুর্গাপুজা। সালটা আজ আর আমার মনে নেই, প্রয়াত সমাজসেবী মনো সেনের উৎসাহেই এ পুজা শুরু হয়েছিল, একসময় আমি নিজেও এ পূজায় উপস্থিত থাকতাম। কয়েক বছর আগে ব্যক্তিদ্বন্দের ফলে এ পুজা ভেঙ্গে দুটো হয়ে গেল। আর শুরু হয়েছিল গার্ডেন স্টেট কালচারাল এসোসিয়েসনের দুর্গাপূজা। তারপর এ বছর গার্ডেন স্টেট কালচারাল এসোসিয়েসন ভেঙ্গে দুভাগ হয়ে গেল, তৈরী হল “মৈত্রী এসোসিয়েসন অফ আমেরিকা বা MAA”, এ বছর থেকে শুরু হল “মৈত্রীর” প্রথম দুর্গাপূজা।তা ছাড়া আরও দু তিনটি ছোট শহরে হচ্ছে বাঙালীর নিজদের দূর্গাপুজো। নিউ জার্সিতে যখন এসোসিয়েসনগুলি ভাঙছে তখন নিউ ইয়র্কই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? এখানেও গত পঞ্চাশ বছরের ECDPA নামক আসোসিয়েসনের দূর্গাপুজা ভেঙ্গে দুটো হয়ে গেল। NYPAর দুর্গাপূজার মধ্যেও গন্ডগোল শুরু হয়েছে, শীঘ্রই হয়ত এ পূজাটিও ভেঙ্গে দুটো হয়ে যাবে। দূর্গাপুজার ব্যাপারে কর্মকর্তাদের সহাবস্থান – নৈব নৈব চ। ভেঙে আরেকটা নতুন পুজো করতেই হবে। আমার মনে হয় – নেতৃত্বের লড়াই ও ব্যক্তিস্বার্থই এজন্য দায়ী।যাক- এ কথা বলে আর লাভ নেই কারণ আমরা সকলেই জানি – যেখানে দুটো বাঙালী সেখানেই তিনটে দল হতে পারে। বাঙালীর মধ্যে সম্মিলিত আয়োজনের সদিচ্ছা বড় কম, আর সেজন্যই সাফল্যের সম্ভাবনাও অতি সীমিত।
এ দেশে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে সাধারনতঃ সপ্তাহান্তে, অর্থাৎ শুক্র, শনি ও রবিবারে। এ বছর পুজো শুরু হয়ে গেল সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ থেকেই। নিউ জার্সির আই সি সি নামক এসোসিয়েসন করল প্রথম দূর্গা পূজা পার্সিপ্যানির হাই স্কুলটি ভাড়া করে। এখানে দেবীর পূজা যথেষ্ট প্রাধান্য পেয়েছে যদিও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কোন খামতি ছিল না। “মদু মাখা দুব্বা ঘাস” শ্রুতি নাটক দর্শকদের মধ্যে হাসির প্লাবন এনে দিয়েছিল। স্ত্রীর চরিত্রে অর্পিতা গুপ্তর অভিনয় প্রভূত প্রশংসার দাবি রাখে। এ হাসির নাটকটি অত্যন্ত নিপূণ অভিনয়ে সকল দর্শকের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠে। প্রখ্যাত গায়ক সৌম্যজিত ও সৌরেন্দ্র জুটির সংগীত পরিবেশন স্কল শ্রোতাদের মুগ্ধ করে দেয়।
এ ছাড়া নিউ জার্সির প্রখ্যাত পূজা তিনটি হল কল্লোল, গার্ডেন স্টেট পুজা কমিটি এবং আনন্দ মন্দিরের দুর্গাপুজা। এদের মধ্যে কল্লোল ও গার্ডেন স্টেটের পুজাতে অংশগ্রহন করতে হলে কম্পিউটারে রেজেষ্ট্রী করতে হবে। না হলে পূজার হলে ওরা কাউকে ঢুকতে দেয় না। কিন্তু এদের প্রতিটি পুজাতেই দর্শকের বন্যা এসে যায়। আর এদের সংস্থাগুলি পূজা করছে গত সাতাস বছরেরও বেশী ধরে। এই পূজাগুলির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলির মান অতি উচ্চ।
“নিউ ইয়র্ক সার্বজনীন দুর্গাপূজা” নামে একটি সংস্থা ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়ারে “ভি এফ ডব্লিউ হল” ভাড়া করে দুর্গাপূজা করে আসছেন প্রায় ৪০ বছর ধরে। এ হলটি বেশ ছোট। বেশী লোকের স্থান দেওয়ার মত জায়গা নেই। তাই এ পূজোতে বেশী লোক হয় না। মনে হয় এবছর এ পূজা ৪০ বছরে পা দিল। ওরা পূজো করলেন অক্টোবরেই । তবে এ পূজোতে পারিবারিক আনন্দের স্বাদ পাওয়া যায়। প্রতিদিন পূজান্তে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এবং প্রতিদিন সন্ধ্যারতির পর মনোরঞ্জনের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ছোট বড় স্থানীয় বা কলকাতার সংগীত শিল্পীরাই সাধারণতঃ দর্শকদের মনোরঞ্জন করে থাকেন এখানে।
তা ছাড়া এখানে কয়েকটি মন্দির আছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নিউ ইয়র্ক কালী মন্দির ও বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির। উভয় মন্দিরেই প্রকৃততিথি নক্ষত্র মেনে পূজা করা হয়। ১লা অক্টোবরপ্রভাতের পূন্য লগ্নে শ্রীদুর্গার আবাহন দিয়ে শুরু হয় কালী মন্দিরের দুর্গা পূজা। কয়েক শতাধিক ভক্তবৃন্দের উপস্থিতিতে মন্দিরপ্রাঙ্গন হয়ে উঠে আনন্দমার্গ। প্রতিদিন ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরন করা হয়েছে।মহা দশমীতে মহিলাদের সিন্দুরদান অনুষ্ঠানের পর পূজা শেষ হয়। প্রতিদিন পূজা ও পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রপাঠ পরিচালনা করেন মন্দিরের পুরোহিত শ্রী সমীরণ চক্রবর্তী। মহাদশমীতে মহিলাদের সিন্দুরদান
অনুষ্ঠানের পর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শুরু হয় দেবী বিদায়ের পালা। সমবেত ভক্তবৃন্দের শুভ বিঁজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু হয়ে যায়। শেষ হয় নিউ ইয়র্ক কালী মন্দিরের দুর্গা পূজা।
জ্যাকসন হাইটের বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির বাংলাদেশী হিন্দুদের মধ্যে অতি প্রিয়। এ মন্দিরে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী হিন্দুরাও নিয়মিত যাতায়াত করেন। এ মন্দিরের সুশৃঙ্খল পরিবেশ উপস্থিত ভক্তগণের মনে ভক্তির উদ্রেক করে। পূজার সময় এখানে কোনরকম বাক্যালাপ নিষিদ্ধ। এটা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কারণ আমি লক্ষ্য করেছি নিউ ইয়র্কের প্রতিটি পূজাতেই পূজা চলাকালীন সমবেত লোকজন বন্ধুদের সাথে বাক্যালাপে ব্যস্ত হয়ে সোরগোলের সৃষ্টি করেন। এ মন্দিরে এত লোকজনের সমাবেশ হওয়া সত্বেও মন্দির ছিল সরোবরের মত শান্ত ও প্রস্তরের মত নীরব। এখানে প্রতিদিন মহাসমারোহে সন্ধ্যারতি করা হয়ে থাকে। বিশেষ আকর্ষণ দেবী আরাধনার ভক্তিমূলক গান। প্রায়শঃই শিল্পীদের সাথে সমবেত ভক্তরাও সঙ্গীতে যোগ দেন। তারপর শুরু হয়ে যায় সমবেত ভক্তদের পরস্পরের মধ্যে শুভ বিজয়ার আলিঙ্গন ও শুভেচ্ছা বিনিময়। এভাবেই শেষ হয় বাংলাদেশ হিন্দু মন্দিরের এ বছরের দুর্গোৎসব।
Brooklyn এর “প্রবাসীর” পূজো হয়ে গেল। এ পূজার বৈশিষ্ট হল যে এটা সার্বজনীন পূজা হলেও চরিত্রগতভাবে পারিবারিক পূজার সমতুল্য। লোক সমাগম কম হওয়াতে এখানে দর্শকগণ নিজেদেরকে একই পরিবারের সদস্য বলে মনে করেন এবং একে অপরের সাথে পারিবারিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। এখানেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এবং স্থানীয় প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ হয়ে থাকে এ পূজাতে। একটু একটু করে এ পূজার বয়সও চল্লিশের বেশী হয়ে গেছে। কোন কারণে এ পূজার কলেবর ক্রমশঃ ক্ষীয়মান, সমর্থনের অভাবে পূজা উদ্যোক্তাগণ হতাশ তবে আশা করেন এ পূজা আবার আগের মতই গৌরবে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
নিউ ইয়র্ক পূজা এসোসিয়েশনের (সংক্ষেপে এন ওয়াই পি এ) ও ইষ্টকোস্ট দুর্গাপূজার কথা না বললে নিউ ইয়র্কের দুর্গাপূজার কথা শেষ হয় না। “গুজরাতী সমাজ হল” শুক্র, শনি ও রবিবার ভাড়া করে দুর্গাপূজা করা হয়। এই তিনদিনের মধ্যেই চার দিনের সপ্তমী,অষ্টমী,নবমী ও দশমীর পূজা শেষ করতে হয়। এদের পূজোতে প্রতি বছর বিভিন্ন পসরা নিয়ে বিক্রেতারা হলের ভিতরে স্টল দিয়ে থাকেন। সাথে থাকে ছোট স্ন্যাকসের দোকান। পাশেই দেখুন কয়েকজন পুরনো বন্ধু মিলে দিব্যি আড্ডা জমিয়েছেন। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় হয় বিচিত্রানুষ্টান। এ বছর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন কলকাতার বিখ্যাত শিল্পীগণ। ওদের সুরেলা কন্ঠের গান সমবেত জনতাকে একটি মধুসন্ধ্যার অবগাহনে ভাসিয়ে দেয়।
নিউ ইয়র্কের অন্যতম প্রাচীন সংঘ হল ইস্টকোস্ট দুর্গাপূজা এসোসিয়েশন। গত বছর থেকেই ইষ্টকোষ্ট দুর্গাপূজা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ পূজোতে কলকাতার সঙ্গীত শিল্পীরা এসে থাকেন দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে। অপর্যাপ্ত ভুড়িভোজের ব্যবস্থা থাকে এ পূজোয়, আর সমবেত ভক্তবৃন্দ অত্যন্ত আনন্দের সাথেই এ ভোজনব্যবস্থা উপভোগ করেন। বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠান শেষে শুরু হল শুভ ঁবিজয়ার কোলাকুলি। দশমীর সন্ধ্যায় বিজয়া দশমীর কোলাকুলিই ইঙ্গিতে ঘোষণা করল ঁমা দুর্গার আরাধনার সমাপ্তি ।
দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে এ পূজাটির কথা উল্লেখ না করলে দুর্গাপূজার কথা শেষ হবে না। New Jerseyর Fort Lee শহরে ডাঃ মিহির বসুর বাড়ির পূজাটি এ বছরই শেষ পুজা হল বলে জানানো হয়। ডাঃ বসু গত দু বছর আগে প্রয়াত হওয়ায় তাঁর স্ত্রী তপতী দেবী San Diegoতে মেয়ের কাছে থাকবেন বলে স্থির করছেন। তাই গত ৩৩ বছরের পূজাটি এ বছরই শেষ বারের মত হল। পুরোহিত শ্রী উমা বন্দোপাধ্যায় ডাঃ মিহির বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ও তপতী দেবীর সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করে এ পুজার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। উপস্থিত সমর্থকগণ ভগ্ন হৃদয়ে একে অপরের প্রতি শুভ ঁবিজয়ার আলিঙ্গন করে ভগ্ন হৃদয়ে নিজ নিজ গৃহের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করেন।
এ ভাবেই শেষ হয় ২০২২র শরতের দেবী মা ঁদুর্গার উপাসনা নিউ ইয়র্ক শহর ও শহরতলীতে। এ স্বর্গসুখের আনন্দ নিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা সকলে অপেক্ষা করব আরো একটি বছর যখন মা দুর্গা আবার আমদের সকলের কাছে ফিরে আসবেন।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment