সে ছিল এক সুন্দর সুপুরুষ সদ্য যুবক, বয়েস একুশ। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের একটি নামি দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্র। আর ‘সে’ ছিল হাল্কা হলুদ রঙের শাড়ি পরা এক তন্বী মেয়ে। দুজনেরই গন্তব্য দিল্লি।
ছেলেটি দিল্লি যাচ্ছিল একটি বড় কোম্পানিতে ফাইনাল ইয়ার সামার ট্রেনিংয়ে । আগামী বছর সে পাশ করবে।
রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়া র একটু পরে মেয়েটি তার জায়গায় এসে বসল, ঘটনা চক্রে একেবারে ছেলেটির মুখোমুখি। একাই যাচ্ছে। সঙ্গে একটা দামি চামড়ার সুটকেস।
ঐ বয়সী ছেলেদের যা হয় , ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে রাজা উজির মারা কিন্তু কোন সুন্দরী মেয়ের সামনে পড়লে একেবারে জুজু।
তবে এক্ষেত্রে একটা ছোট তফাৎ হল। মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী এবং কম বয়সী হলেও বেশ সপ্রতিভ। হয়ত দিল্লির মেয়ে বলে। সে নিজেই প্রথম হ্যালো বললো বর্ধমানের কাছাকাছি গিয়ে ঠিক যখন বেয়ারা চা-টা দিয়ে গেল।
ছেলেটির আর কোন লজ্জা বা আড়ষ্টতা রইল না। এমনিতেও সে মোটেই মুখচোরা নয়। বরং তার ঠিক উল্টো। কলেজে তার শ’য়ে শ ‘য়ে বন্ধু। কাজেই ট্রেন আসানসোল পৌঁছতে পৌঁছতে ওরা তাদের জীবন কাহিনীর অনেকটাই একে অপরকে বলে ফেলল।
মেয়েটি গুজরাতি। বয়েস কুড়ি। দেশের এক নামকরা ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। দিল্লিতেই বেড়ে ওঠা, স্কুল কলেজ ইত্যাদি। আপাতত মিরান্ডা হলে ফাইনাল বছর। কলেজে ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন।
পরের দিন একটু বেলায় ট্রেন যখন দিল্লি পৌঁছল ততক্ষনে একে অপরের অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। মেয়েটি শেষমেশ
বলেই ফেলল এই নাও আমার ঠিকানা। একদিন ফোন করে চলে এস। বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমার বাবার অনেকরকম ব্যবসা আছে। লেখাপড়া শেষ করে অনায়াসে একটা ভালো চাকরি পেয়ে যাবে। মেয়েটির গলায় কি যেন এক অব্যক্ত ইঙ্গিত, নাকি ভবিষ্যতের হাতছানি?
ছেলেটি খুব খুশি। মেয়েটির ঠিকানা আর ফোন নম্বর টা তো না চাইতেই পাওয়া গেল। সেটাই তো আসল পাওয়া। আরো কত কথার মধ্যে দিয়ে যে বাদ বাকি যাত্রাপথ টুকু কেটে গেল তা কেউ ই বুঝলনা। হঠাৎ রেলগাড়ি নিউ দিল্লি পৌঁছে গেল।
দিল্লি পৌঁছে ট্রেনিংয়ের চাপ, অন্যান্য ট্রেনিদের সঙ্গে অফ টাইমে দিল্লি বেড়ান, করিমের বিরিয়ানি, কনট প্লেস, কুতুব মিনার ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে কটা মাস কোথা দিয়ে কেটে গেল বোঝাই গেলনা।
হলুদ শাড়ির কথা বেমালুম ভুলে গেল। পথিকে পথিকে দেখা পথের আলাপন। কতই তো হয়।
তার কথা আবার মনে পড়ল কলকাতা ফেরার মাস খানেক বাদে। পুরোন কাগজের মাঝ থেকে বেরিয়ে এল সেই ছোট্ট চিরকুট। মেয়েলি হাতের লেখা। দিল্লির সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পাড়ার ঠিকানা এবং মেয়েটির বাবার নাম দেখে ত ছেলের চোখ ছানাবড়া।
কিন্ত সে মেয়ে তার মনের মধ্যে যেন গেঁথে গেছে। শয়নে স্বপনে মনে পড়ে। শুনে বন্ধুরা খেপায়। কিন্তু তাতে কার
কি আসে যায়?
ফোন করতে গেলে অনেক সাহস লাগে। যদি কথা না বলে? যদি তার বাবা ফোন তোলে? অনেক ভাবনা চিন্তা করে শেষমেশ একটা চিঠি লিখে ফেলল। ওই যেরকম হয় আর কি।
সেদিন আমরা ট্রেনে খুব ভালো গল্প করেছিলাম, এখন খুব পড়ার চাপ, তুমি কেমন আছ, আমি ভাল আছি, ইত্যাদি ।
চিঠি টা ডাকবাক্সে ফেলে নিজেকে একটু হালকা লাগল। জবাব আসবেনা সে তো জানাই আছে।
দিন দশেক বাদে একটা খাম এল । সেই চেনা হাতের লেখা। তোমার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লাগল। কেন এলেনা আমাদের বাড়ি? পড়ার খুব চাপ। তুমি কেমন আছ, আমি ভাল আছি, ইত্যাদি ।
তারপর তিনদিন তো রাতে ঘুম নেই। নিদ নাহি আখিপাতে। তারপর একটু সাহস সঞ্চয় করে একটা চিঠি লিখেই ফেলল। তোমার কথা রোজ মনে পড়ে।
চার পাঁচ দিন পরেই জবাব মিলল। হ্যাঁ আমিও তোমাকে মিস করছি।
এর পর দুপক্ষেরই আর কোনো আড়ষ্টতা রইল না। শুধু নিয়মিত চিঠি আর চিঠি। যত মনের কথা, যত হৃদয়ের কবিতা, সব উজাড় করে ঢেলে দেওয়া। কমপক্ষে একশ চিঠির আদান প্রদান।
পরের বছর শীত কালে মেয়েটি জানাল বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু হয়েছে। ব্যাবসায়ী পরিবারে মেয়েদের একটু তাড়াতাড়িই বিয়ে হয়।
ছেলেটি তখন সবে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। কলকাতায় এক পুরনো পাড়ায় পুরোনো বাড়িতে যৌথ পরিবারের মধ্যে ঘাড়ের ওপর ঘাড়ের ওপর থাকা। না আছে নিজের বাসস্থান না আছে জমানো টাকা। তার ওপরে বিরাট বড়লোকের মেয়ে । কি জানি তারা ওকে কি চোখে দেখবে।
সাত পাঁচ ভেবে একটু পিছিয়ে গেলো সে। মুখ ফুটে ঠিক বিয়ের প্রস্তাব টা আর দিতে পারলো না। যথাসময়ে একটি রঙচঙে দামি নিমন্ত্রনের কার্ড এলো।
যাকে আমরা চ্যাপ্টার বলি সেটা এখানেই মোটা মুটি শেষ হয়ে গেল।
তিন-চার বছর পরে ছেলেটির ও বিয়ে হলো। বাবা মা নিজেরা দেখেশুনেই পাত্রী জোগাড় করেছেন। সুন্দরী মেয়ে। বাংলা বলে। গান জানে। রন্ধন পটিয়সি। এবং পাল্টি ঘর। আর কি চাই। সোনায় সোহাগা।
ধীরে ধীরে সবই হোল। চাকরিতে উন্নতি, নিজের ফ্ল্যাট, ফুটফুটে সন্তান। সপরিবারে সুখে শান্তিতে ও আনন্দে কেটে গেল অনেক গুলো বছর।
চাকুরী সূত্রে অনেক জায়গা ঘুরে শেষে স্থিতি হল নাগপুরে। তখন সে আর ছেলে নেই। একটা কোম্পানির বেশ বড় গোছের কর্তা। সারাদিন মিটিং করেন, আর সব কর্তাদের মতো।
একদিন একটা জরুরি মিটিংয়ে গিয়ে এক উচ্চ প্রতিষ্ঠিত গুজরাতি ব্যাবসায়ীর সঙ্গে আলাপ। তাঁর পদবী শুনেই হটাৎ মনে পড়ে গেল সেই হলুদ শাড়ি পরা মেয়েটিকে। একই পদবী। কি মনে করে উনি জিজ্ঞেস করেই বসলেন। বেরিয়ে পড়ল তেনারা পরস্পরের ঘনিষ্ট আত্মীয়। আরো শুনলেন সে মেয়ে নাকি বিয়ে থা করে বর, ছেলেপুলে নিয়ে সেই শহরেই থাকে।
তার ঠিকানা ও ফোন নম্বর গুলো কয়েক দিনের মধ্যেই হাতে এসে গেল।
সাহস করে ফোন করতে আরো দিন পনের কেটে গেল। তারপর একদিন ফোন করেই বসলেন। কাজের লোক ফোন তুলল। ম্যাডাম বাড়ি নেই। বাঃ বাঃ বাঁচা গেল।
কিন্তু মাথার পোকা তো ঘুরেই যাচ্ছে। কাজেই তিন দিন পরে আবার ফোন করলেন। এবার সে নিজেই ফোন তুলল। গলা টা সেই রকমই আছে। কি জানি কিরকম দেখতে হয়েছে।
নাম শুনে এক বারেই চিনতে পারল। সেই পুরনো দিনের উচ্ছাস ফিরে এলো গলায়। বলো কবে আসবে আমার বাড়ি? সবাই মিলে গল্প হবে।কত কথা জমে আছে। শিগগিরই আসবো। ফোন করবো তোমায়।
ফোন টা নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ বেশ আনমনা হয়ে গেলেন বড়কর্তা সাহেব।
কত যুগ পরে আবার মনের মধ্যে ভিড় করে এলো সেই পুরোনো সেই দিনের কথাগুলো। সেই শ’য়ে শ’য়ে চিঠি। সেই কথা আর কথা। সেই বুকের মধ্যে একটু কিরকম যেন লাগা।
বর্তমান জীবনের কথা ভাবলেন। বাড়ি, গাড়ি, সম্মৃদ্ধি, সুনাম। টাকা। পরিবারের উজাড় করা ভালবাসা। বড় আদরের স্ত্রী ও সন্তান।
জীবনের অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসেছেন তিনি। অনেক টা রাস্তা পেরিয়ে এসেছে সেও। পুরনো দিনের স্মৃতি তার নিজের জায়গাতেই স্মৃতি হয়ে থাক। সেই ভালো।
ধীরে ধীরে সেই নতুন ঠিকানা লেখা কাগজ টা আবার পকেট থেকে বার করলেন। শেষ বারের মতো পড়লেন। তারপর ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিলেন। ব্রিফকেস টা বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
বাড়ি যেতে হবে।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment