স্বর্গে বাতি – একটি আলোকিত বিশ্বাস
হিমাংশু পাল
প্রুফ রিডিং : তমালিকা
আমাদের শৈশবে গ্রাম বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য ছিল খুবই প্রকাশ্য ও বর্ণময় | এক একটা ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে তার রূপ আকাশে , বাতাসে , জলে – স্থলে সমগ্র পরিবেশের আয়নায় প্রতিফলিত হত | সেই সঙ্গে শিশু ও কিশোর মনের অন্তরের অন্তস্থলেও সুগভীর দীর্ঘস্থায়ী ইম্প্রেশন পড়ত | শুধু ভাল লাগা বা শুধু মন খারাপ করা নয় , বিশেষ ঋতুর বিশেষ ক্ষনে কোন এক বিশেষ ঘটনা কোন এক কিশোর বা সদ্য যুবার মনে এমন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার ছাপ ফেলত যে সেটা কোন ভাষা বা সাহিত্যে প্রকাশ করা সম্ভবপর ছিল না !! অথচ কয়েক দশক পরে সেই সুপ্ত স্মৃতি কোন উপযুক্ত পরিস্থিতিতে অঙ্কুরিত হয়ে আবার সেই বিচিত্র অনুভূতির বৃত্তি সমূহ কয়েক মুহূর্তের জন্য ফেলে আসা সেই শৈশবে টেনে নিয়ে যায় !!
তখন আমি ক্লাস সিক্স কিংবা ক্লাস সেভেনে পড়ি | আমাদের গ্রামে তখনও কোনো ইলেকট্রিক আলো ছিল না , ছিল না কোন টিভি , ফোন বা অনন্য সব আধুনিকতার ছোয়া | বড় বড় গাছ গাছালিতে ঘেরা বড় বড় মাটির বাড়ী গ্রাম বাংলার শোভা বৃদ্ধি করত | সন্ধ্যার অল্পক্ষণ পরেই কেরোসিনের ক্ষীণ আলোয় এক ভুতুড়ে পরিবেশের চেহারা নিত | ছোটবেলায় তিনটি জিনিষকে খুব ভয় করতাম – ভুত , সাপ আর ডাকাত | সন্ধ্যের পর একলা বাড়ীর বাইরে যেতে হলে ঈশ্বরকে সঙ্গে নিতাম | আর ভাবতাম স্বর্গ থেকে বাবা , ঠাকুরদা ও আরো পূর্ব পুরুষেরা উপর থেকে সর্বক্ষণ আমাদের আশীর্বাদ করছেন আর রক্ষা করবেন |
কার্তিক অগ্রহায়ণের হালকা শীতের আমেজে মনোরম সন্ধ্যায় স্বর্গে বাতি দেওয়ার অনুভূতি এখন বেশ মনে পরে ! একদিন দুদিন নয় , পুরো মাস ধরে স্বর্গে বাতি দিতে হত | মেজ জ্যাঠামশাই বুনোপুকুর কিংবা ঢ্যাং ঘেরের বাঁশ ঝাড় থেকে বেছে বেছে লম্বা ও সুডৌল বাঁশ কেটে বলতেন এটা নিয়ে চল স্বর্গ বাতি তৈরি করতে হবে |
জ্যাঠামশায়ের অনেক কাজের প্রধান সহযোগী ছিলাম আমি , হেমাং বলে ডাকতেন | ঢ্যাঁড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শন বা পাট থেকে দড়ি তৈরি করতেন | সেই দড়ি ঢ্যাঁড়া ভর্তি হলে আবার আমার ডাক পরতো , “ হেমাং দড়ি ছাড়বি আয় “ | মোটা মোটা রশির দড়ি পাকাতাম | সেই সব দড়ি দিয়ে গরু বাধা হত , সাংসারিক বিভিন্ন কাজ কর্মে ব্যবহার করা হত| পাট করা দড়ির বান্ডিল থেকে শক্ত পোক্ত সৌখিন দড়ি বেছে নিতেন স্বর্গে বাতি দেওয়ার জন্য | বাঁশের গায়ে গায়ে কিছুটা দূরে দূরে রিং লাগিয়ে তার ভিতর দিয়ে দড়ি পরিয়ে পুরো বাঁশের গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত লাগিয়ে সম দৈর্ঘের দড়ি রিংএর বাইরে লাগানো হত| তারপর দড়ি সমেত বিশাল গগন ছুয়ে যাওয়া বাঁশ টাকে লম্বা লম্বি সটান দাড় করান হত, সদর দুয়ারের কিছুটা সামনে ছোড়দার ডাব গাছের পাশে | লণ্ঠনের বাতি ওই দড়িতে বেঁধে কপিকলের মতো দড়ি টেনে টেনে বাতিটিকে বাঁশের ডগা পর্যন্ত তুলে দেওয়া হত|
কথিত আছে সহজ সরল বালকের বিশ্বাস পাঁচ সিকে পাঁচ আনা | ভুতেও যেমন বিশ্বাস , আবার ঈশ্বরের অস্তিস্তেও অগাধ তার বিশ্বাস | আর হবেই না বা কেন – রাতের অন্ধকারে একা একা বাড়ি ফেরার সময় কাত্তিক পুকুরের নৈঋত কোনে যে শ্যাওড়া গাছটা ছিল সেটা হটাৎই কেন যেন মাথা ঝাকিয়ে উঠত ! গ্রামের সবাই জানত যে ওই শ্যাওড়া গাছটাই নাকি আত্মহত্যা করা সব ভুত ,পেত্নী ও বেম্বোদত্তিদের আড্ডাখানা| তাছাড়া শীতের রাতে মেজ জ্যাঠাইমা – বড় জ্যাঠাইমা যে সব রোমহর্ষক গল্প বলতেন সেগুলোই বা কি করে অস্বীকার করা যায় ? সম বয়সী আমার এক বালক বন্ধু কানে কানে এক মন্ত্র শিখিয়ে ছিল যেটা উচ্চারণ করে সমস্ত বিপদ আপদ অনায়াসে অতিক্রম করে এসেছি ! সে মন্ত্র শক্তি ই বা কাজ করে কিভাবে ?
স্বর্গে বাতিদানের গোড়াপত্তন কবে বা কেন হয়েছিল তার ইতিহাস নিয়ে এই ছোট্ট বালকের মনে কোন প্রশ্ন ওঠেনি | কিন্তু বাতিদান যে একটা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান এটা নিয়ে কোন সংশয় ছিল না | প্রথাটা ছিল পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশে “স্বর্গে বাতিদানের প্রতীক “ | ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও পূর্বপুরুষদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা মিডিয়াম | হেমন্তের ছোট্ট বিকেলে গ্রাম্য বন্ধুদের সঙ্গে খেলা ধুলা সেরে পা হাত ভর্তি ধূলো বালি মেখে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন বেশ অন্ধকার অন্ধকার হয়ে যেত | গা ছম ছম পরিবেশে তবুও সেই ভীতু ছেলের মন আনন্দে মেতে উঠত !! স্বর্গে বাতি দিতে হবে বলে !! রোমাঞ্চ হত !! কার্তিকের কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার সান্ধ্যকালীন নিস্তব্ধতায় চোদ্দ পুরুষ কেন কয়েক সহস্র পূর্বপুরুষ যেন স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ করত !!! বালকের স্থির বিশ্বাসে লণ্ঠনের বাতি গ্রাম বাংলার অন্ধকারের আলস্য অতিক্রম করে কোন স্বর্গ রাজ্যে পৌছে যেত – যেখানে যুগ যুগ ধরে তার মতো সহস্র শত কোটি বালকের বিশ্বাস একত্রিত হয়ে সমগ্র স্বর্গলোক আলোকিত করে এসেছে !
হিমাংশু পাল
প্রুফ রিডিং : তমালিকা
21 November 2019
“স্বর্গ বাতি “ – একটা লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ সভ্যতার আনুষ্ঠানিক প্রথা
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment