*রক্তঘাম*
কলমে তনয়া বিশ্বাস।
মা……
মা…..রে লক্ষী…….
—–হ্যাঁ বাবা বলো ….এস ঘরে এসো…. এই সেলাইয়ের কাজ গুলো একটু করছিলাম আর কি?
মায়ের শরীরটা এত খারাপ মা আর সেলাই এর কাজগুলো এগোতে পারছে না। তাই ভাবলাম আমি একটু এগিয়ে রাখি।
_বল বাবা কিছু বলবে?
-হ্যাঁ ওই আর কি: তোর সাথে একটু কথা ছিল!!!
-মাথায় হাত রেখে গোবিন্দ বাবু বললেন!-মারে পাশের গ্রামের ব্যানার্জি বাবু আছে। আমার মালিকের চেনাজানা আর কি? তার ভাইয়ের ছেলের জন্য তোকে খুব মনে ধরেছে ওদের।সেদিন ব্যানার্জি বাবুদের বাড়িতে পয়তের অনুষ্ঠানে তোকে দেখে ছিল না !!সেই খান থেকে ওদের তোকে পছন্দ হয়েছে।
উনারা বলল-তারা যদি তোকে যদি বউ করে তাদের হাতে তুলে দিতে পারি তবে তোর ভাইয়ের এর একটা হিল্লে করে দেবে- এ জন্মের মত-তোর ভাইয়ের জন্য শহরে কাজ ও যুটিয়ে দেবে তারা। সাথে টাকা-পয়সা তারা দেবে কিছুই নেবে না শুধুমাত্র তাদের তোকে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চাই।
শোন না মারে-দেখ আমাদের অবস্থা তো খুব একটা ভালো নয়। আজ আছি কাল নেই তোর মায়ের শরীরের অবস্থা ভালো নয়। সম্বন্ধটা নিজে যখন যেচে এসেছে… তুই আর না করিস না মা । হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না।
তুই একটু ভেবে দেখিস মা।-___যা সিদ্ধান্ত নিবি আমাদের তিনটে পেটের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিস।
…..? তারপর কিছু কথা বলে গোবিন্দ বাবু ঘর থেকে চলে গেলে ন।
দরজাটা হাওয়াতে দড়াম করে এসে বন্ধ করে হলো।
লক্ষীর মনটা প্রশ্নের মেলাতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এখন যদি বিয়ে হয়ে যায় পড়াশোনাটা আর এগিয়ে নিয়ে যাবে কি করে? টাকার বিনিময়ে যারা আমাকে নেবে তারা কি আর আমাকে পড়তে দেবে কোনদিন?
ঘরের সমস্ত কাজ করার পর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সত্যি সম্ভব হচ্ছিল না তবুও নিজের জেদের কাছে কখনো হেরে যায়নি লক্ষী।
তবুও বাবা-মার কথা ভেবে পরদিন সকালে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল সে বিয়েতে রাজি। ওর বাবা-মায়ের চোখের কোনটা কেমন যেন চিকচিক করে উঠলো লক্ষীর কথা শুনে।
সপ্তাহের দুই এর মধ্যে অনেক তোর জোর করেই বিয়েটা হয়ে গেল। ছেলের বাড়ি থেকে বেশি তারা ছিল। লক্ষ্মী ও তার মনের মতানৈক্য আর বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েটা করে ফেলল।
বিয়ের পর নতুন বাড়িতে এসে-
*******০
বিয়ের পর থেকে স্বামীকে হয়তো একবার দেখেছে সে, সেই শুভদৃষ্টির সময়, কেমন কেমন একটা যেন তাকানোর অস্বাভাবিক ভঙ্গি, হাসিটা কেমন যেনো অন্যরকম । সব সময় উপরের ঘরে একা একা বন্ধ থাকে, লক্ষীর মনটা কারণটা জানার জন্য সব সময় খচখচ করতে থাকলো।
।ফুলশয্যার রাতে লক্ষ্মী শাশুড়ির সাথে শুয়ে ছিল, সবাই বলাবলি করছিল তার স্বামীর নাকি কিসের বাড়াবাড়ি হয়েছে খুব নাকি শরীর খারাপ? কিন্তু সে তো তার স্ত্রী তাকে তো কিছু জানতে দিল না, তাকে তো কাছে ঘেষতে দিলো না, অনেক অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে নিজেকে নিজের কাছে?
বাড়ির সবাই একদিন স্বামীকে নিয়ে গিয়েছিল একটা তান্ত্রিক এর কাছে, তাকে অবশ্য কেউ নিয়ে যায়নি। এমন কি তো সেটা ও জানত না যে তান্ত্রিক এর কাছে গেছে,ওই বাড়ির কাজের লোক কথায় কথায় তাকে বলল।
বাড়ির কাজের লোক যাওয়ার পর অনেকটা সাহস করে ওপরে উঠল নিজের স্বামীর ঘরটায় দেখার খুব ইচ্ছে জাগল তার।
ঘরটা একদম বারান্দা র শেষ কনাই। বেশি বড় না মাঝারি মাপের একটা ঘর। সে দিকে এগিয়ে চল ল লক্ষী।
-_____ ঘরের দরজাটা আস্তে করে খুলতেই,… কেমন যেন একটা ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ হলো। বুকের ভেতরটা কেমন দুরুদুরু একটা অজানা ভয়। ঘরটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে… খুবই অগোছালো। অনেক প্রশ্ন মনে …বাড়ির সব থেকে বড় ছেলে, এমন করে তাকে কেন থাকতে দেয়। ঘরে যেন কার ছবি??? একটা বয়স্ক মহিলা -একটা মায়াবী মুখ মায়া ভরা চোখ। মুখের অনেকটা মিল আছে তার স্বামীর মুখের সাথে। দেওয়াল থেকে ফটো টা হাতে তুলে ভালো করে দেখতে শুরু করলো লক্ষ্মী।রাখতে যাবে এমন সময় পা টা আটকে গেল নিচে পড়ে থাকা জামা কাপড়ের মধ্যে।সারা জামা কাপড়ে কি সব যেন লাল লাল লেগে রক্তের মত…. কিছুটা দেখে ভয় পেয়ে গেল শরীরের ভেতরটা শিউরে উঠল ওর । হাতে তুলে- – -জামাটা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধটা নিল। সব মানুষের নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে। জামাটায় যেনো কেমন ওষুধ ওষুধ গন্ধ, কেমন যেন রক্তের গন্ধ । সাবটা মিশে বিদঘুটে গন্ধটাকে ঠিক নিতে পারল না লক্ষি।
বাম দিকে তাকাতেই দেওয়ালের দিকে চোখ পড়তেই-দেখল কত বই। সেই দিকে এগিয়ে গেল লক্ষী। একটা বই মুখের কাছে টেনে নিয়ে মনে মনে ভাবল,
তার স্বামী , হয়তো বই কে খুব ভালোবাসে পড়তে। মনে মনে এটাই আকাঙ্ক্ষা করলো যে তাহলে হয়তো তার পড়াশোনাটা সে চালিয়ে যেতে পারবে। অনেক মোটা মোটা বই। চোখে দেখেনি কোনদিন লক্ষী। আর একটা বই নামিয়ে আনতে টেবিলে র দিকে চোখ গেল তার। সামনে একটা বাক্স রাখা। বাক্স টা হাতে নিয়ে খুলতেই কত রকমের ওষুধ বাক্স। এত বাক্সভর্তি ঔষধ কার???? একটা মানুষকে এত ওষুধ খেতে পারে কখনো??? তাহলে কি তার স্বামীর অনেক বড় রোগ?? চোখটা কেমন ছল ছল করে এলো?? ওষুধগুলো একটা ও চেনা না। কত ধরনের রকমের ওষুধ । মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন। দেওয়ালের দিকে তাকাতেই দেখলো ঘড়িটা বন্ধ। টেবিলের ওপর জলের ঢাকনাটা ও কেউ দেয়নি। ঘরটা ঝুলে ভর্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরটা ঠিকঠাক করে গুছিয়ে…. তারপর ভাবল না আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।
… কেউ চলে এলে মুশকিল হতে পারে। মনে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল লক্ষী।
******
কোন প্রশ্ন করলেই -শাশুড়ি নতুন বউ বলে মুখ বন্ধ করিয়ে দিত। মেয়ে মানুষের মনে এত প্রশ্ন কেন? নতুন বউ বউ এর মতো থাকো.. পুলিশ হতে যেও না। এভাবেই ধমকে চমকে তাকে চুপ করিয়ে রাখত। বাড়িতে এত লোকজন সবাই যেন লক্ষী র থেকে দুরে দুরে থাকত।
বাড়িতে অনেক সময় অনেক কেউ থাকত না। প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে সে উপর স্বামীর ঘরে যেত। অগোছালো ঘরটা গুছিয়ে রেখে চলে আসত। কিন্তু কখনোই চোখ এড়ায়নি মেঝেতে পড়ে থাকা লাল লাল ছোপ… জামায় দেওয়ালে.. ভয়ে বেরিয়ে আসতো ঘর থেকে।জানলার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখত। কেমন যেন সব অস্বাভাবিক লাগতো। পুরো ফাঁকা বাড়ি তার দায়িত্বে রেখে চলে যেত। আগেকার দিনের পুরনো বাড়ি, লক্ষ্মী বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে কোথায় কি আছে খালি মনে মনে ভাবতো নিশ্চয়ই কোনো অজানা রহস্য আছে যেটা ও জানে না সবাই ওর চোখে লুকোচ্ছে।
****
বাগানের গাছে জল দিতে, পাশের বাড়ির বউটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে এক নজরে। লক্ষী চোখে চোখ পড়তেই বউটা মুখটা নীচে নামিয়ে নিলো। লক্ষ্মী ডেকে বলল-
বৌদি……
বউ টা যেন সব শুনেও না শোনার ভান করল, অন্য দিকে পা বাড়িয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলো।
এখনো বুঝতে পারছ না সবাই ওর এভাবে কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
মনের মধ্যে অনেক আশঙ্কা, অনেক অন্ধকার, অনেক না জানা র বাসা বাঁধতে শুরু করলো……..আরো।
########
এই মধ্যে লক্ষ্মী শশুরের শরীরটা প্রচন্ড খারাপ করলো একদিন রাতে। ধরাধরি করে পাশের গ্রামের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে… সেখানকার ডাক্তার বলে দিলো শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য… সেই রাতে নিয়ে চলে আসা হলো কলকাতায়…. বাড়িতে মালতি কাজের মেয়ে, উপরের ঘরে স্বামী, নিচের তলায় তার ননদ আর লক্ষী… এত বড় বাড়িটা য় কেউ ছিল না সেদিন। ছোট ননদ খুব ভালোবাসত লক্ষী কে। নিশ্চুপ বাড়িতে লক্ষ্মীর মনের অনেক প্রশ্ন বুকের পারে এসে বার বার ধাক্কা দিচ্ছিল।
লক্ষ্মী আর ননদ একসাথে বসে গল্প করছিল। কথায় কথায় লক্ষ্মী ওর ননদ (রিম্পি)কে বলল-:::::::::
-রিম্পি তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
++হ্যাঁ করো?
-তোর দাদা ওই ঘরে ওভাবে একা একা কেন থাকে?? না নিচে আসে ??না কেন কেউই বা ওর ঘরে যায়?? না আমাকে বা ওই ঘরে যেতে দেয় না কেন??
++আমি কিছু জানি না বৌদি মা জানে। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম বৌদি আমার কিছু মনে নেই।
-বলনা রিম্পী মা আমার…. সবাই আমাকে দেখলে এড়িয়ে কেনো যাচ্ছে।পাশের বাড়ির বৌদি টা আমাকে দেখেও হনহন করে দৌড়ে পালিয়ে গেল?? আমি কি কোন দোষ করেছি।
-কাঁদতে কাঁদতে অঝোরে ভেঙে পড়ল লক্ষী। সবাই কী লুকোচ্ছে আমার থেকে আমি কিছু বুঝতে পারছিনা??
++পিঠে হাত দিয়ে বললো রিমপি। বৌদি কেঁদোনা। তোমায় একটা কথা বলবো কাউকে বলবে না তো।তখন আমি খুব ছোট ছিলাম বড় হয়ে যেটুকু জেনেছি সেটুকুই তোমায় বলছি।
-কাউকে না তুই আমায় সবটা বল। তোর দিব্যি রইল আর কিছু বলবো না।
++আমি দাদা এক মায়ের সন্তান নই। বাবার প্রথম পখ্যের সন্তান দাদা। বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান আমরা তিনজন। আমার 2 দাদা। মেজদা এখানে থাকে না। ডাক্তার বাইরে থাকে। আর ছোট্ট দা ওর খবর জানি না। ব্যবসার কাজে ভুল হিসেবে দিয়ে পাওনাদারকে ঠকানোর জন্য বাবা ওকে বাড়ির বাইরে বার করে দিয়েছিল। তারপর থেকে আর আমাদের সাথে থাকেন। বড়দা ছোট থেকে পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। একবার বন্ধুরা কলেজ ওকে অনেক রাগিং করেছিল। তারপর থেকে ও কেমন মুষড়ে থাকতো। ওর ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়ার। সারাদিন বই নিয়েই থাকত।। তারপর কলেজে রাগিং এর মাত্রা টা ওর বেড়ে গেছিল।
++তারপর দাদা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকত। ঠিকমতো পড়াশোনা করত না। উচ্চমাধ্যমিকের খুব বাজে নাম্বার করেছিল ও। বাবা মাকে অনেক কিছু বলেছিল।তারপরেই সর্বভারতীয় ডাক্তারি পরীক্ষায় দাদা চান্স পেল না।। পড়াশোনা থেকে আস্তে আস্তে অনেক দূরে সরে আসতে শুরু করলো।। মানসিক হতাশা ওকে পুরো আঁকড়ে ধরল।।। তারপর ড্রাগস, অ্যালকোহল এ বুদ হতে শুরু করল।। তারপরও দিন দিন কেমন পাগল পাগল হতে শুরু করল।। ডাক্তার দেখিয়ে ওকোন লাভ হল না।।
++দাদার শরীর ভালো না বৌদি। দাদার ওপর অশরীরী আত্মা ভর করে আছে সবাই মনে করে। সবাই দাদার থেকে দূরে দূরে থাকে। তাইতো দাদাকে তান্ত্রিক এর কাছে নিয়ে যাও হই।
++দাদা সুস্থ মানুষ না। উন্মাদ একটা। মানুষকে খেকর তার সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরে। কেউ ওর ধারের কাছে যায় না।
++প্রচন্ড রাতে একা একা কাঁদে; একা একা হাসে; দাদার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোয়।। নিজের চুল নিজে ছেড়ে….
++পাড়ার সবাই আমাদের থেকে দূরে দূরে থাকে। সবাই ভাবে এটা নাকি ভুতুড়ে বাড়ি।।
++তান্ত্রিক বলেছে ওর উপর একটা অশরীরী আত্মা ভর করে আছে। বলেছিল বিয়ের পর নাকি ঠিক হয়ে যাবে… তাড়াতাড়ি করে বিয়েটা হয়ে যায় তোমার সাথে……
বাবা ও চেয়েছিল দায়িত্ব নেয়ার জন্য কাউকে আনা হবে বাড়িতে। তাই বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি করে সারা হয়েছিল।
বলেই রিম্পি জাপটে ধরে লক্ষ্মী কে ধরে কাঁদতে শুরু করল।। কাউকে বলো না বৌদি তোমার পায়ে পরি।
লক্ষ্মী ও কেমন প্রচন্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, চোখ দিয়ে যেন জল টাও বেরোনো বন্ধ হয়ে গেছে।। এইসব ও কি শুন ল এতক্ষণ ধরে ।।।।।
-তুই যেগুলো বললি সেগুলো সত্যি?? এটা হতে পারে না। অসম্ভব ব্যাপার।
++নাগো বৌদি সত্যি বলছি। ও যখন কাঁদে ওর চোখ থেকে রক্ত বেরোয়। ও যখন দরদর করে ঘামে তখন ওর শরীর দিয়ে রক্ত বেরোয়। মাঝে মাঝে ওকে সামলানো দায় হয়ে যায়।। আমরা ভয়ে কেউ ওর কাছে যায় না।।। সবই অশরীরী আত্মার কাজ।।ওই অশরীরী আত্মা যতদিন নাও শরীর থেকে যাবে ততদিন ও ঠিক হবে না তান্ত্রিক মশাই দিয়েছেন বলে।।
-অশরীরী আত্মা বলে কিছু হয়না রিম্পি এগুলো আমাদের মনের বিশ্বাস মনের ভুল।একটা সুস্থ ছেলে হট করে কেন অশরীরী আত্মার কবলে পড়বে।। আমাদের সবার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে রিম্পি।। আমাকে একবার উনার সাথে কথা বলতেই হবে।।
++আজ তো কেউ নেই বৌদি বাড়িতে- প্রমাণ চাওতো তুমি একবার দাদার ঘরে গিয়ে ঢুকে দেখো।। একটা রাত দাদার ঘরে থেকে দেখো।।
-ঠিক বলেছিস আজকেই সুযোগ। সব সত্যি তো আমি বার করে ফেলব। এরকম কিছু হতেই পারে না।।
******
রিম্পি কে নিচে রেখে -দুরুদুরু বুকে ওপরের ঘরে যাচ্ছে লক্ষী। চোখটা কেমন ছল ছল করে উঠছে তার বারবার। রিমপির কথা গুলো চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। ওর জীবনে এত বড় একটা ঘটনা একবারও কেউ জানাল না। যদি সত্যিই এমন হয় তাহলে সারাটা জীবন কাটাবে কি করে…. এগুলো ভাবতে ভাবতেই উপরের ঘরে যাচ্ছিল।
ঘরে ডিম লাইটটা জ্বলছে।। ঘরের একটা দরজা বন্ধ একটা দরজার পাল্লা অর্ধেক খোলা। লক্ষী দরজায় টোকা দিল…..? ঠক ঠক ঠকে
বেশ ভারী গলার একটা কণ্ঠস্বর-কে???
কে এই সময়???
(লক্ষ্মী স্বামী দেবাশীষ)
লক্ষী-দেবাশিস বাবু!!!!!! ভেতরে আসবো আপনার সাথে কিছু কথা আছে,…(আমতা আমতা করে কিছুটা ভয়)
দেবাশীষ-হ্যাঁ এসো। আমার মত একটা উদ্বাস্তু পাগলের সাথে তোমার কি কথা থাকতে পারে?? কেন এসেছে আমার ঘরে জানো না আমার ঘরে আসা বারণ কার????
লক্ষী:::
______-বিয়ের রাত থেকে তো আপনার সামনে একবারও আসেনি ।।আমি একবারও দেখিওনি আপনাকে তাই দেখতে এলাম আপনার নাকি শরীরটা খুব খারাপ ছিল তিন দিন ধরে!!! মা আসতে বারণ করেছিল তাই আর আসিনি। এখন আপনি কেমন আছেন??
দেবাশীষ-একটা পাগল যেমন থাকে ঠিক তেমন আছে!! দেবাশীষ মাথা নিচু করে ফেলল। গলাটা কেমন শুকিয়ে শুকিয়ে আসতে দেবাশীষ এর।
ঢকঢক করে জল চা খেতে খেতে দেবাশীষ বললো. তোমার নামটা কি যেন???
:::: লক্ষী।
দেবাশীষ-তোমাকে একটা কথা বলি লক্ষী। মন দিয়ে শোনো। আর ভুল করেও এই ঘরে কোনদিনও আসবেনা। এই ঘরে আসা কারও বারন।। আমি আমার জীবনটা সবার থেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছি আমার নতুন করে পাওয়ার কিছু নেই।।
লক্ষী-তাহলে আমার জীবনটা নষ্ট করলেন কেন আমার সাথে বিয়ে করে। আপনাদের তান্ত্রিক একটা মহিলা বলি চেয়েছে সেই জনৈ। কেন আমার কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে গেলেন আপনারা… কেন আমার পরিবারকে ঠকালে ন???
দেবাশীষ-এতে আমার কোন হাত নেই লক্ষী। আমি তো বিয়ের সকালেও জানতাম না আমার বিয়ে। সবটাই জোর করে আমার হাত-পা বাঁধা।।। বলতে বলতে দেবাশীষের চোখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে…….
লক্ষী র দেখে হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে গেল…. দেওয়ালের এককোণে ভয়ে সিঁটকে আছে সে…. আপনার চোখ দিয়ে রক্ত বের হই???? আপনি সাধারণ মানুষ নন??
দেবাশীষ-তুমি ভাবছো তো আমার শরীরে অশরীরী আত্মা ভর করে আছে। আমার চোখের জলটা রক্তের আকারে পরছে।। আমিও নিজেকে নিজের থেকেও বেশি ভয় পায়।।
লক্ষী- আপনার চোখটা মুছে নিন।আমার খুব ভয় লাগছে।বিশ্বাস করুন দেবাশীষ বাবু রিমপির মুখ থেকে শব্দ শোনার পর আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করিনি আপনার মুখ থেকে শুনব বলেই আজ আমি আপনার মুখোমুখি এসে ছি।
অশরীরী আত্মা বলি তান্ত্রিক সব কিছু ভন্ড সব কিছু মিথ্যে…….. আমি সেটা অবিশ্বাস করেছি বলে আজ আপনার কাছে আপনার মুখ থেকে আমি সত্যিটা জানতে চাই।
দেবাশীষ জানলার ধারে তাকিয়ে চোখটা বন্ধ করে আছে-
দেবাশীষ বলতে শুরু করল-
যেদিন আমাকে ওরা তান্ত্রিক এর কাছে নিয়ে গেছিল, সেদিন ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরটা কিছুটা গোছানো। সেদিন কেই সন্দেহ হয়েছিল তুমি আমার ঘরে এসেছো । মা চলে যাবার পর আমি আমার ঘর কোনদিনও গোছায় নি।
ওই যে ফটোটা দেখছো ওটা আমার মা ওটা আমার নিজের মা। যাকে একই কারণে মরতে হয়েছিল। এই যে আজকে আমার চোখ দিয়ে জলের বদলে রক্ত পড়ছে, মায়ের একি রোগ হয়েছিল। সবাই মাকে কাল নাগিনী… পিশাচিনী বলে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল। সেই অপমান নিতে না পেরে মা ট্রেনে ঝাঁপ দিয়েছিল। তারপর থেকে আমি মা হারা….. তারপর আস্তে আস্তে আমার জীবনটা অন্য খাতে বইতে শুরু করেছিল।।। নিজের লক্ষ্য থেকে অনেক অনেক দূরে আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগলাম আমি। যাকে ভাবছো আমার মা বলে তিনি আমার সৎ মা। যিনি আমার জীবনটা নিজের হাতে ধ্বংস করে দিয়েছে শুধুমাত্র টাকা পয়সা ধন সম্পদ এই বাড়ির ভাগ এর জন্য।।।
আমি সুস্থ আমি স্বাভাবিক।। এই যে দেখছো আমার চোখ দিয়ে রক্ত পরছে আমি খুব ঘামলে আমার সারা শরীর দিয়ে রক্ত ফেটে আসে।। এটা একটা বিরল রোগ।। আমার বড় ভাই আমার সৎ মায়ের প্রথম সন্তান বিদেশে নামকরা ডাক্তার। ও আমার অসুখটা সনাক্ত করতে পেরেছিল।। ঠিকমতো চিকিৎসা করে আজ হয়তো আমি সুস্থ হয়ে যেতাম।। কিন্তু আমাকে সুস্থ হতে দেয় নি কিছু মানুষের নোংরা মানসিকতা।
সুস্থ হলে যদি বাড়ির সম্পত্তি আমি চাই সেই জন্য আমাকে আর সুস্থ হতে দিতে কেউ চায় না।। আজ ডাক্তারি পড়লে আজ আমি আমার বড় ভাই এর থেকে অনেক বড় ডাক্তার হতে পারতাম… মা মারা যায় যখন ক্লাস সেভেন প্রথম দিকে… মা মারা যাওয়ার পরে এমনি কষ্ট থাকতাম…. বছর এক এর মধ্যেই বাবা আমার কথা ভেবে আর একটা বিয়ে করেছিল। সৎ মা আমাকে কিছুতেই পড়তে দিত না বই খাতা লুকিয়ে রাখত পুড়িয়ে ফেলত … লুকিয়ে রাখত।।
বাবাকে কিছু বলা মানা ছিল।। ব্যবসার কাজে বাবা বাইরে বাইরে থাকত।।।
আমার কিছু করার ছিল না লক্ষ্মী তোমাকে ঠকাতে চাইনি আমি।। আমি যদি সবটা জানতাম কক্ষনো তোমার জীবনটা নষ্ট করতাম না।। আমাকে এক ধরনের ওষুধ দিয়ে আমার নার্ভ গুলো কি নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছিল। জাতে বিয়েটা মুখ বুজে সেরে ফেলি।।
সমাজের চোখে আমি উন্মাদ পাগল। আমাকে অশরীরী আত্মা ভর করেছে। আমি অসুস্থ।। কিছুদিন পর হয়ত আমাকে কেউ মেরে ফেলবে।। সবটা জানি আমি।। সবকিছু।।
সবটা শুনে লক্ষ্মী মেঝেতে বসে পড়েছে-
হাউমাউ করে কাঁদছে।। লক্ষ্মী আজকে বাকরুদ্ধ।। কিছু বলার ক্ষমতা ও যেন তার লোপ পেয়েছে।।
মিনিট 30 পর-
লক্ষী::::দেবাশিস বাবু… কেন আপনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে না। কেন আপনি নিজের জীবনটা এভাবে শেষ করে দিচ্ছেন অন্যের প্রতিহিংসার জন্য সবটা জেনেও কেন আপনি সবকিছু মেনে নিচ্ছেন??
আপনার রোগটা কি কোনদিনও সাড়বে না??
এটা কি রোগ?? এমন ভয়ানক??
দেবাশীষ:: আমি প্রতিবাদ করলে তো আমার মা ভায়েরা আমার বিরুদ্ধে এমন একটা ভয়ঙ্কর গল্প বানিয়ে . বাবা কে বোকা বানিয়ে সবার চোখে ভাবে ধুলো দিতে পারত না… গ্রামের প্রত্যেকটা লোক জানে আমার মা আমাকে চোখে হারায়… সত্যিটা শুধুমাত্র আমি জানি… আজকে তুমি জানলে…?
রোগটা হেমাটহাইড্রোসিস। বাংলায় রক্ত ঘাম। তীব্র মানসিক উদ্বেগ হলে অথবা খুব কোন কিছুতে শঙ্কিত হলে, কপাল গাল হাতের কনুই বে য়ে ঘামের সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে ফোটা ফোটা রক্ত। রোগটা আসলে জিনগত ।আমার মায়ের বাপের বাড়িতে ও রোগ টা ছিল সেখান থেকে আমার মায়ের সেখান থেকে আমার।
মুখ্য কারণ এটা মানসিক অবসাদ।। যাদের হয় এটা তাদেরকে সবাই এক ঘরে করে দেয় তার ফলে মানসিক অবসাদ তা আরো বেড়ে যায়।।
আপাতত হার্ট ও রক্তচাপের ওষুধ এটার ওষুধ।।
চিকিৎসা করাতে অনেক খরচা।। দেশের বাইরে যেতে হবে।। টাকা-পয়সার অবশ্য অভাব নেই।। বানানো গল্প টা থেকে নিজেকে বার করতে পারি না কোনদিন ও।।
সবটা শুনে লক্ষ্মী বলল-আমি থাকবো আপনার সাথে। আমি আপনাকে সুস্থ করে তুলবো।।। দয়া করে আপনি সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসুন।। আপনার এইসব মানসিক কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসুন।। আর কারো র জন্য হোক অন্তত আমার জন্য।। লক্ষ্মী উঠে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে দেবাশীষের হাতটা ধরলো।।
অনেক বোঝাল দেবাশীষকে। ন বছর পর দেবাশীষ কারো সাথে এত কথা বলল।। যে সমস্ত মনের কথা সব বলে দিল লক্ষ্মী কে।। লক্ষীও কেমন বোকার মত তাকিয়ে আছে ।
আলমারি থেকে দেবাশীষ মায়ের গয়না গুলো বার করে দিল লক্ষ্মী র হতে। তুমি যা চাইবে তাই হবে।। আগে কেউ এভাবে পাশে এসে দাঁড়ায়নি লক্ষী কেউ আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করেনি। ওরা বাবাকে ও ওই ঘরে আসতে দেয় না । খুব কষ্ট দেয় আমাকে । আমি জানি বাবা আমার জন্য খুব কষ্ট পায়।। আমি পারবো লক্ষী…দেশের বাইরে যাব আমরা চিকিৎসা করতে।।
লক্ষ্মী বলল::: কথাটা আমি আর আপনি ছাড়া কেউ জানবে না,। বাড়ি থেকে আমাদের লুকিয়ে বের হতে হবে।। না হলে সামনে আরো বাধা-বিপত্তি এসে যাবে।। কেউ আপনার ভালো চাইনা। এটা সুযোগ এখান থেকে বের হওয়া র । আজকে রাত্রের মধ্যে যা করার করতে হবে।।
দেবাশীষ মায়ের ফটো টার দিকে তাকিয়ে বলল-আরো বাঁচতে হবে আমাকে… তোমার জন্যই বাঁচবো আবার নতুন করে লক্ষী। যারা অন্যায় করেছে আমার জীবনের সবটুকু টা কেড়ে নিয়েছে, আমার বাবা কে ঠকিয়েছে, আমাকে উচ্চতার শিখরে পৌছাতে দাইনি, তাদেরকে আমাকে শাস্তি দিতেই হবে…. কেউ ছাড় পাবে না…কথা দিলাম।। দুজন দুজনার হাত টা শক্ত করে চেপে ধরলো…… কালকেই আমরা বেরিয়ে পরব।
এভাবে আরো দুটো প্রাণ এগিয়ে গেল নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে… নিজের চোখকেও অনেক সময় অবিশ্বাস করতে হয়।। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন।। ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকুন।
নমস্কার।।
Name-Tanaya Biswas
College-RCC Institute of Information Technology
Class-B.Tech 2nd year
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment