গভীর নিম্নচাপ, ক্রমাগত বৃষ্টিতে ভেজা স্কুল বারান্দা৷
ছেলেটি ঠায় দাঁড়িয়ে গেটের বাইরে, উল্টোদিকে স্কুল ইউনিফর্মে ইতস্থত মেয়েটির মাথায় লাল টুকটুকে ছাতা৷ আর গোটা মাঝখান জুড়ে ঝিরঝির বৃষ্টি৷ ভিজছে শহর, ভিজছে মন৷
ছেলেটি এখনও দাঁড়িয়ে, তাই মেয়েটির কপট রাগ,
‘এভাবে আর কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবি’?
ছেলেটির মুখে দুষ্টুমি,
‘যতক্ষন না স্কুল খুলবে তোর’৷
অসহিষ্ণুতা গায়ে মেখে মেয়েটি গটগট করে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে, মাঝপথে থমকে আবার ফিরে আসে,
‘ভিজছিস তো’?
ছেলেটির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি,
‘আমি ভিজছি৷ তুই ফিরে এলি কেন’?
থেমে যাওয়া বাস থেকে নামলেন মাষ্টারমশাই, ঠিক তক্ষুনি স্কুল গেটের সামনে থেকে ছেলেটি সাইকেল নিয়ে দে ছুট৷ সাথে সাথে মেয়েটিও ত্রস্ত পদক্ষেপে উঠে এল স্কুল বারান্দায়, মিশে গেল বান্ধবীদের ভিড়ে৷
ওদিকে সেভেনের দুটো ছেলের মধ্যে কম্পিটিশন, কে আগে ছাতা নিয়ে পৌঁছাতে পারে মাষ্টারমশাইএর কাছে৷ কার ছাতা মাথায় দিয়ে, কাঁধে ভরসার হাত রাখবেন মাষ্টারমশাই!
বামদিকের বারান্দায় ক্লাস ফাইভের মন খারাপ, পকেটে দশটা টাকা থাকা সত্বেও অসহায়৷ পাশের সিক্স বলে উঠলো,
‘আমাকে একটা আইসক্রিম দিবি বল, তাহলে ছাতা দেব’৷
ক্লাস ফাইভের মুখ উজ্বল, বিশ্বজয়ের আনন্দে ক্লাস সিক্সের হাত ধরল,
‘চল তাহলে, দুজনে মিলে যাবো৷ তুই একটা আইসক্রীম আর আমি একটা৷ ভাল করে ছাতাটা ধরবি, আমাকে ভেজাবিনা কিন্তু’!
একটা ছাতা আর দুটো মাথা এগিয়ে চলল গেটের বাইরের আইসক্রীম দাদুর দিকে৷ কিন্তু সিক্সের ক্লাসরুমটার একদম কোনের দিকে একটা ভীষন মন খারাপ! এত বৃষ্টিতে কেউ স্কুল আসে? তাছাড়া বাবা গতকালই মাত্র এসেছে, সোনারুপোর কাজ করতে তো সবদিন সেই বাইরেই থাকে৷ আজ আবার মাংস আর খিচুড়ি হবে ঘরে৷ মা বলল,
‘এসে খাবি! এখন স্কুলে যা’!
তারওপর আজ আবার অঙ্কস্যরের ক্লাস, অঙ্ক না পারলে স্যার খুব রাগ করেন৷
স্কুলের দক্ষীণ বারান্দায় ক্লাস নাইন দুরন্ত! ছাদের কার্নিশ হয়ে বৃষ্টির দ্বিগুন বেগে ঝরে পড়া ছাদের জলটাই টার্গেট৷ বেশ কয়েকজন মিলে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলছে এক একজনকে সেই জলে৷ পরের বার কাকভেজা সেই ছেলেটিই দলে যোগ দিয়ে অন্য কাউকে ভেজানোর দায়ীত্বে৷
আরও একটা বাস থেকে সদ্য নামা, ছাতা মাথায় দিদিমনির গোটা মুখে হঠাৎ হতাশা৷ গেট থেকে স্কুলের বারান্দা পর্যন্ত গোটা রাস্তা জল থৈ থৈ৷ কিংকর্তব্যবিমুঢ় দিদিমনি স্থির দাঁড়িয়ে, জরিপ করে নিচ্ছেন কোন পথে গেলে শুধু গোড়ালিটুকুই ভিজবে৷ দিদিমনি পা রাখলেন, কাদামাখা জল উঠে এল গোড়ালি ছাড়িয়ে আরেকটু ওপরে! আর সেটা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ক্লাস এইটের মধুখ্যাপা৷
মধুসুদন সবসময়ই হাসে, কারনে হাসে, অকারনে হাসে, ক্লাসে হাসে, ক্লাসের বাইরে হাসে, পরীক্ষার হলে হাসে, ফেল করলে হাসে, শাস্তি পেলে হাসে, মিডডেমিল খেলে হাসে৷ মধু সবসময় হাসে, তাই ওর বন্ধুরা বলে মধুখ্যাপা৷ খুব ছোট্টবেলায় বাবা ওকে ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে চলে যাবার সময় ওর সব অনুভুতিগুলোও সাথে নিয়ে গেছে৷ তাই মধু শুধুই হাসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসে, মাটির দিকে তাকিয়েও হাসে৷
হঠাৎ মধু খেয়াল করে, মাটিটাও হারিয়ে গেছে৷ ভরা বর্ষায় জল থৈ থৈ, হারিয়ে গেছে মধুর পা দুটোও, মধু ভয় পায়৷
এমন সময় ঘন্টা পড়ে, ঢং ঢং ঢং ঢং!
শুরু হয় ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে… উচ্ছল জলধিতরঙ্গ’৷
—সমাপ্ত
বয়স—৩১
সহশিক্ষক, রামজীবনপুর বাবুলাল বিদ্যাভবন৷
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment