সকালসকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার, তবে বৃষ্টি নামেনি। বিকেল হতেই মেঘেরা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, আর আকাশের নীল রং নরম আলোয় স্পষ্ট হচ্ছে। টুকরো টুকরো গোলাপী আর হলুদ সেই নীলের গা ঘেঁষে স্বপ্নরচনা করছে। তবে অপরাজিতার মনের বিষণ্ণতা কমেনি এখনও, মন খারাপের কারণ অজানা তাও ভালো লাগছেনা কিছুই। M.sc প্রথমবর্ষের ছাত্রী ও। পরীক্ষা শেষ হয়েছে, সায়রতটে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তাও হলনা বেরোনো। পরিবর্তে চলছে রোজকার নিয়মমাফিক জীবন।
পছন্দের নীল চুড়িদার পড়ে পড়াতে গেল ও ওর ছোট্ট ছাত্রী ঋতুকে। ‘Fraction’ আর ‘Multiples’ নিয়ে যুদ্ধ চলছে তার মাঝে হঠাৎ “Ma’am ও Ma’am, আর পড়বনা, আমার সঙ্গে খেলতে চলুননা”
“ ইয়ার্কি হচ্ছে? কম্পিউটারের উত্তরগুলো ঠিকঠাক হয়নি, বাংলা বাকি আর এখন তোমার সাথে খেলব আমি?”
“ Pleaassee, আপনাকে বালি দিয়ে প্রাসাদ বানিয়ে দেব; ওখানে আসবে রাজকুমার, রাজকুমারী”
এক ঝটকায় অপরাজিতা ফিরে গেল বেশ অনেক বছর আগে। Fairy Tales খুব প্রিয় ছিল তার, কিন্তু যত বড় সে হয়েছে কল্পনাশক্তিকে তত দূরে ঠেলে দাঁড়িয়েছে কঠিন অপ্রিয় বাস্তবের মুখোমুখি। “ ইইঁপাথরের জঙলে বালির প্রাসাদ!!!”
“ সত্যি সত্যি, একবার অন্তত চলুন। Please”
কি জানি কি মনে হল অপরাজিতার,বলল “ তাড়াতাড়ি ঠিকভাবে পড়ে নাও, খেলব”.
চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো ঋতুর, বিনা বাক্যব্যয়ে মন দিয়ে পড়া করে নিল সে-“ আপনার সব কথা শুনেছি, এবার চলুন”
“কোথায় যাব?”
“এইতো সামনের পার্কে”
“বেশ চল”
পার্কে যদিও খুব বেশি আলাদা কিছু ছিলনা। তবুও অগোছালো গল্প আর কল্পনার আল্পনায় ছোট্ট ঋতু রূপকথার রাজ্য বানিয়েছে সেখানে। হাতের খেলনা গাড়ি নিয়ে সে বলে “ দেখুন লালমোহনবাবুর Green Ambassador এইখানে থামবে। আর ঐ রাস্তা দিয়ে আসবে ফেলুদা আর তপশে”
অপরাজিতার কত সখ ছিল তপশে হওয়ার কিন্তু ফেলুদাকেই তো খুঁজে পায়নি আর। ঋতু Construction Site থেকে বালি তুলে এনে বানাচ্ছে প্রাসাদ, টাওয়ার, ইগলু আরো কতকি। সত্যিতো এত ভালোবাসা দিয়ে বানানো সাম্রাজ্যে কি আর রাজপুত্তুর পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে না এসে থাকতে পারে??
ঋতু বলল আকাশের বুকে নীল চাদরমোরা পরীদের রাজ্য আছে, তারা রঙ নিয়ে খেলা করলে আকাশ রং পাল্টায়, ওরা কাঁদলে বৃষ্টি পড়ে, ভেজে সারা শহর। সাধের রডডেনড্রন, করবী, চাঁপা, টগর নিজের ছন্দে মহানন্দে দুলছে। ঋতুর এই সুখের জগতে দুঃখের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। আমরা যত বড় হই, ততই ব্যস্ততা বাড়ে, হাতে দামী ঘড়ি থাকে তবে সময়ের দাম বুঝিনা। দৈনন্দিন জীবনের মাঝে সামান্যতায় অসাধারণত্বের সন্ধান করিনা, রোমাঞ্চিত হইনা, স্বপ্ন দেখাও দিয়েছি ছেড়ে। যা পাই তার আকণ্ঠ রসাস্বাদন না করে যা না পাই তার পিছনে ছুটি। এতটাই materialistic হয়ে উঠেছি যে চোখের সামনে হাজার হাসির কারণ থাকলেও তাদের ছুঁয়ে দেখিনা। বিশ্বাস করতে ভালোবাসতে ভুলি, প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বটাতেও ইতিরেখা পড়ে যায়।। খুঁত খুঁজতে খুঁজতে নিরেট, নিখাদ কোনকিছুর মাহাত্ম্য বুঝিনা। এসব ভাবতে থাকে অপরাজিতা।
এতক্ষণে ওর মুখে হাসি ফুটেছে, আনন্দে বাঁচার একটা নতুন পথ পেয়েছে, আর তার হদিস মিলছে ঋতুর থেকেই। জীবনটাতো সাদা কালো অবশ্যই, তবে তুলি কিন্ত আমাদের হাতেই আছে, দেখার এটাই যে কে কতটা রঙিন করে নিতে পারে নিজের জীবন ক্যানভাসকে।
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment