জানালার কাঁচে আঁজি আঁজি দাগ কাটা। বাইরের সব প্রতিকণারা কাঁচ বেয়ে তাই যতক্ষণে উপচে পরে ঘরে, তার মধ্যেই কিভাবে যেন রঙ পালটে ঘোলাটে লাগে মিয়ানো চোখ। মনে হয়, জমাট বাঁধছে মুষড়ে পরা পেঁজা তুলোর দল অকালবোধনে।
বিয়ের আগেও তো বেশ কয়েকবার সোহমের বাইকের পিছনে চেপে এসেছে অয়ন্তিকা এই ঘরে — কই, তখন তো এমনভাবে চোখে পরেনি ব্যাপারটা? উল্টে বরং এই মাটি থেকে কার্ণিস ছোঁয়া জানালা বেশ মনেই ধরেছিল তার। বিকেলের ফিকে হয়ে আসা আলোয় এক পশলা স্বপ্নও বুনতে শুরু করেছিল সে সোহমের কাঁধে মাথা এলিয়ে — পরিকল্পনায় উঠে এসেছিল টুকরো টুকরো ভাষাভাষা ছবির মতো নিপাট নিখুঁত ক্যানভাস। সাততলার এই ঘরটা পুব খোলা – ঘুম ভাঙলেই দিব্যি সেখানে ভেসে উঠবে নিখাদ নিটোল অরুণোদয় — রোজ। তার উজ্জ্বলতায় উজ্জীবিত হয়ে এইসূত্রেই নাহয় নিজেদের একান্ত একটুকরো সংসারে নতুন করে বেঁচে উঠবে তারাও – প্রতিনিয়ত!
“বউমা, ঘরে ছেলেমানুষ কাউকে পাঠাবো? তোমার সাথে এসে শোবে?” কমলা হঠাৎ করেই সাড়া না দিয়ে দরজা খুলে প্রশ্ন করেন তাঁর ঘরে সদ্য পা রাখা নববধূর উদ্দেশ্যে।
চমকে ওঠে অয়ন্তিকা। তারপরেই সামান্য বিব্রত হয়ে পরে সে তার অহেতুক এই আচরণে। “না মা, আমি একাই থাকতে পারব, অসুবিধার তো কিছুই তেমন দেখছি না!”
“তা বেশ! সে কথাই তো কখন থেকে বলছি সোহমের বাবাকে, ‘আজকালকার মেয়েদের আবার ভয়ডর কি? বিয়ের আগে দেখগে যাও, কত রাত কাটিয়ে গেছে ও মেয়ে এখানে’ – তা যদিও আমরা দেখতে আসিনি, তবু, ওই আর কি! খবর তো পেয়েই যাই! যাগগে, আমাদের তো দিন ফুরালো— তোমাদেরই এখন সময়! ওসব নিয়ে আর বুড়ো বয়সে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ, তাই না! ব্যস সময়মতো নাতির মুখটুকু দেখলেই – – তা,ভিতর থেকে দোর দিয়েই শুয়ো, কেমন?” আর কথা বাড়ালেন না কমলা। জটিল হাসির রেখাখানা মুখ জুড়ে ভেসে উঠল একবার। তারপরেই স্বশব্দে পাল্লাদুটো টেনে দিলেন বাইরে থেকে। কোনো উত্তরের প্রত্যাশা রাখলেন না।
অয়ন্তিকার শরীরের ভিতরকার কোনো খাঁজ থেকে একরাশ শূন্যতা উঠে এলো শুধু – কাল রাত থেকে পরে থাকা লাল বেনারসী আর গয়নাগুলো তাতে আরো কিছুটা চেপে বসল গায়ে- এর বেশি কিছু না।
জানালার ঘষা কাঁচের গায়ে হাত বোলায় অয়ন্তিকা। ওপাশে এতক্ষণে নিশ্চয়ই পূর্ণিমার চাঁদ, আর দিগন্তবিস্তৃত জ্যোৎস্নার বাহার! খুব নীচের দিকের ঘর হলে গাড়িঘোড়ার আওয়াজ হয়তো আসত। তবু যা হোক, কিছুটা হলেও প্রাণের পরিধিও তো বাড়ত, তাই না? রাজারহাটের রাস্তার ধারে ঝাঁ চকচকে নতুন গড়ে ওঠা এই আবাসনে যখন প্রথম বাড়ি দেখতে এলো তারা, তখন অবশ্য অন্যরকম সব অবাস্তব ভাবনাদেরই অয়ন্তিকা শুধু জমতে দিয়েছে তার মনে। উঁচুতলার এই অ্যাপার্টমেণ্টটা নিতে তাই সেই একরকম জোরও করেছিল বলা চলে সোহমকে, “নানা, এটাই ভালো গো! কোনো আওয়াজ নেই, ভিড়ভাট্টা নেই, কি সুন্দর নিরিবিলি! ঠিক কি মনে হচ্ছে জানো গো, মনে হচ্ছে শহরের থেকে অনেক, অনেক উঁচু দিয়ে ভেলায় গা এলিয়ে যেন নিশ্চিন্তে ভেসে চলেছি আমরা!”
সোহমের ঠোঁট কপাল ছুঁয়ে গিয়েছিল তার। “ঠিক দেখেছো? তা ভেলা আমরা চালাচ্ছি না সংসার?”
গয়নাগুলো একটা একটা করে খুলে রাখে অয়ন্তিকা। ঝাপসা কাঁচে আর তল পায়না অবেলার শ্রাবণধারার কোলাহল। শাড়িটা খুলতেও আলসেমি ধরে বড্ড, ভয়ও হয়, পাছে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে ঝরে পড়ে যায় বিয়ের আগের স্বাধীনতার শেষ রক্তক্ষরণও!
চাকুরিরতা এক মধ্যযৌবনার রমণীর কাছে সামাজিকতা, অনুষ্ঠান, লোকাচার, কন্যাদান, কালরাত্রি — এসবই আর পাঁচটা হুজুগের মতো চোখের পলক পরা বরাবর কেটে যাওয়া ঘোর মনে হয়েছিল অয়ন্তিকার। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের বাদ্যির সাথেই যেখানে চলতে থাকে লক্ষ্মী আরাধনার ধুম। কয়েকটা দিনের তো মানিয়ে নেওয়া নিয়ম – তারপরে শুধু সে, সোহম আর নিজেদের হাতে গুছানো ছোট্ট নোঙর করা সংসার! বিয়ে তো শুধু একসাথে থাকার কিছু নৈতিকতা আর দলিল দস্তাবেজ— তারপরের কাটানো জীবনেও সামাজিকতার কি অদৃশ্য কোনো হাত তবু থেকে যায়?
ধেবড়ে যাওয়া কাজল আর মুখের মেকি সব রঙগুলো একসাথে উঠে এসে পাক খেতে থাকে আয়নায়। ইতিমধ্যেই চোখ কোটরে ঢুকে জায়গা মতো গুছিয়ে নেয় নিজেকে। আলতো করে ছেলেবেলার পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে নিতে চায় অবচেতন শান্তিতে আর দোটানায়। ঝুটো নথটা বেকায়দায় চেপে বসেছিল এতক্ষণ এমনভাবে,মাঝরাতের খামখেয়ালে পুরো নাকটাই তাই ফুলে উঠে অসাড় অবাধ্য হয়ে গেছে যন্ত্রণায়। অথচ এসবে আর হুঁশ ফেরেনা অয়ন্তিকার। বৌভাতের সাজের জিনিস গোছানোর পালা ছকে নিতে নিতেই আড়চোখ তার নজর চলে যায় জানালায়। –
আর মাত্র কিছুক্ষণের আঁধার, পরাধীনতা। এবার শুধু রাতজাগা ঘুম আর ক্লান্তির বেদনায় ভর দিয়ে দিনের আলো ফুটিয়ে তোলার নিদারুণ প্রতীক্ষা।
একটাই দুরাশা – বরাবরের সব দেশের প্রতিটি বিবাহিত নারীর মতোই হাল কিছুতেই ছাড়বেনা অয়ন্তিকাও। আবার হাট করে পাল্লাদুটো খুলে গেলেই নতুন উদ্যমে নেমে যাবে সেও ময়দানে। অসুবিধা যতই থাকুক না কেন – ঠিক তুলে আনবে সেই শেষমেশ, ছোটবেলার জাঁতাকলে ঘুরপাক খেতে থাকা, ভেঙে যাওয়া সব পাথরবাটির খেলনা!
Parijat Banerjee
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment