কলমে : সৌমি জানা
দুপুর থেকে শুরু হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব। উফ্ কি সর্বনেশে ঝড় ! হাওয়ার উত্তাল শব্দে দোতলা বাড়িটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। বৃষ্টির প্রচণ্ড ঝাপটায় জানলার কাঁচগুলো মনে হচ্ছে এক্ষুনি খানখান হয়ে যাবে ! বাইরে বড় বড় গাছগুলো মাতালের মতো দুলছে ঝোড়ো হাওয়ায়। ডাইনিং টেবিলের পাশের চেয়ারটায় বসে বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো মনোরমার। নিজের অজান্তেই কখন যেন টেবিলক্লথটা এক হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরেছেন। আর এক হাতে টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাসটা ঘনঘন নিজের মুখে তুলে ধরছেন। বিধাতার কোনো এক রোষে বাইরে যেন মহাপ্রলয় শুরু হয়েছে। এ যাত্রায় বুঝি আর শেষরক্ষা হলো না !
আতঙ্কে শিহরিত হয়ে উঠলেন মনোরমা দেবী। বয়স তার ষাটের কোঠায় । দুই ছেলে কর্মসূত্রে বিদেশে। বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। আজ প্রায় বাইশ বছর হতে চললো পৃথিবী ছেড়েছেন তার স্বামী , অধ্যাপক মনোরঞ্জন দত্ত। বইপত্রের নেশা ছাড়াও সংগীতের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন প্রফেসর দত্ত। একবারও চোখে না দেখে শুধু তার গান শুনেই সদ্য যুবতী মনোরমাকে হৃদয় দিয়েছিলেন মেধাবী তরুণ মনোরঞ্জন। এসব সেই কত যুগ আগের কথা , তবু যেন এখনো চোখের সামনে ভাসে মনোরমার। গল্পে, গানে, কবিতায় ভরে থাকতো দুই ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। তারপর একদিন হঠাৎ অসহ্য বুকে যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন মনোরঞ্জন। ডাক্তার বললো ফ্যাটাল কার্ডিয়াক ফেলিওর। ছেলে দুটি তখন সবে ক্লাস নাইন আর ফোর। তিনদিন যমে মানুষে টানাটানির পর অবশেষে নেতিয়ে পড়ল মনোরঞ্জনের পার্থিব শরীর। দুইপাশে দুই ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে পাথরের মতো শূন্য দৃষ্টিতে দাঁড়িয়েছিলেন মনোরমা। সেটাও ছিল এমনই এক ঝড়ের রাত।
বাইশ বছর আগের সেই ঝড় তছনছ করে দিয়েছিলো মনোরমার সুখ, শান্তি , সংসার। এর পরের দিনগুলি শুধু সংগ্রাম – নিজের মনের সাথে আর বাইরের কঠিন পৃথিবীর সাথে। বহু ঘাত -প্রতিঘাত সহ্য করে সন্তানদুটিকে বড় করেছেন তিনি। দুই ছেলেই উচ্চশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত আজ। ছেলেদের নিয়ে তাদের বাবার স্বপ্ন মিথ্যা হতে দেননি মনোরমা। শুধু গানটা চিরতরে হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে।
চেয়ারে বসে এক লহমায় কত কথা মনে পড়ে গেল মনোরমার। অন্ধকার হয়ে গেছে , সেই সঙ্গে বেড়েছে ঝড়ের দাপট। মনটা কেমন আনচান করছে তার। টলতে টলতে উঠলেন চেয়ার ছেড়ে , ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যা দিতে হবে। ঠাকুরের সিংহাসনের পাশেই নিজের হাতে বানানো একটি আসনের ওপর স্বামীর আবক্ষ ছবি রেখেছেন মনোরমা। ঠাকুরের কাছে ধুপ দীপ জ্বালিয়ে ছবিটির সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসলেন তিনি। মনে হলো আজ অনেক দিন পর ছবির মানুষটি যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাকে কাছে ডাকছে। ওইতো পরিষ্কার শুনতে পেলেন সেই গম্ভীর অথচ পরম পেলব কণ্ঠ , “ভয় করছে রমা ? ভয় কি , আমি তো আছি। ” আহা , কি অসীম আশ্বাস ওই কন্ঠে ! আজ এতগুলো বছর তিনি ওই আস্থা ও আশ্বাসটুকুর জন্যই তো হাহাকার করেছেন !
আকুল হলেন মনোরমা। চোখে এলো প্রচণ্ড জলোচ্ছাস , হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইলেন ছবির মানুষটিকে ! “ওগো তুমি এসেছ ..…কেন হঠাৎ চলে গেলে আমায় একা ফেলে …..এত কষ্ট কেন দিলে তুমি আমায় ?” ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চলে গেল , সন্ধ্যা প্রদীপের নিভুনিভু আলোয় স্পষ্ট দেখলেন মনোরমা , সম্মুখে বসে আছেন তার স্বামী মনোরঞ্জন , নিজের দুহাতে তার হাত দুখানি ধরে। আর একটুও ভয় করলো না তার , শরীর ও মনে এক অব্যক্ত প্রশান্তি অনুভব করলেন তিনি। কতকাল পরে ফিরে পেয়েছেন তার ভরসার আশ্রয়। অস্ফূট মৃদু স্বরে বললেন , “তোমার বাবুন আর ছুটুন কত বড় হয়েছে জানো ?” ” সব জানি রমা , তুমি অনেক কষ্ট করে ওদের মানুষ করেছ। তোমার জন্য আমার কত গর্ব। কিন্তু নিজেকে বড় অযত্ন করেছো তুমি। গানটাও ছেড়ে দিলে। ” এইবার অভিমানে গাঢ় হয়ে আসে মনোরমার গলা , ” কার জন্য গাইবো গান ? আমার গান শোনার মানুষটি যে আমাকে সাড়া জীবনের মতো একলা রেখে হারিয়ে গেল !” মনোরঞ্জন তার চিবুকটি তুলে ধরে বললেন , ” এইতো এসেছে তোমার গান শোনার মানুষ , তাহলে এখন গাও। ”
“আর কি পারব আমি, গলা যে আমার অনেক দিন আগে শুখিয়ে গেছে গো ” করুণ সুরে বললেন মনোরমা। “কে বলেছে রমা তোমার গলা শুখিয়ে গেছে। অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো তোমার অন্তরের গভীরে বইছে সুরের ধারা। আমি তৃষ্ণার্ত পথিক, তোমার সঙ্গীত সুধায় আমায় পূর্ণ কর আবার।” এই অনুনয় ফেরাতে পারলেন না মনোরমা, সেই বিয়ের প্রথম দিনটি থেকে কোনোদিনই তিনি পারেননি তার ভালোবাসার মানুষটির এই আবদার অগ্রাহ্য করতে। এদিন ও পারলেন না। প্রদীপের নিভুনিভু আলোয় ঠাকুর ঘরের এককোণে পরে থাকা বহু বছরের অব্যাবহৃত ধুলোপড়া তানপুরাটি টেনে নিলেন পরম যত্নে। তানপুরার তারে সদ্য প্রস্ফূটিত কৈশোরের চাঞ্চল্যে সুরের ঝংকার তুললো তার ষাটোর্ধ প্রবীণ অঙ্গুলি। প্রিয়তমকে ফিরে পাওয়ার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে গেয়ে উঠলেন , ” যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে….জানিনাই তো তুমি এলে আমার ঘরে ”
আহা কি অপূর্ব তার সুরের মূর্ছনা , কি দরদ্ তার কন্ঠে, কি কাতর আকুতি তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে ! বাইশটি বছর ধরে কত যে না গাওয়া সুরমালিকা জমা হয়েছে তার হৃদয়ে, আত্মবিস্মৃত যোগিনীর ন্যায় সেগুলিই একটির পর একটি গেয়ে শোনালেন তার প্রাণসখাকে। আর তার পাশটিতে বসে শুনলেন বহুদিনের পথভ্রষ্ট সুরবঞ্চিত মনোরঞ্জন। অদম্য স্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন স্ত্রীর মাথায় , মুছিয়ে দিলেন তার চোখ থেকে ঝরা অশ্রুবিন্দু। একসময় সুরের বন্যায় ধরে এলো মনোরমার কণ্ঠ , চোখদুটি বুজে এলো স্নিগ্ধ আবেশে, পরম শান্তিতে স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। বহু যুগের পর আবার এত নিশ্চিন্ত ঘুম এলো তার জীবনে। বাইরে তখন ও বইছে ঝড়। আশ্চর্য্যজনকভাবে মনোরমার জীবনের ঝড় বুঝি থামলো সেই রাতে।
পরদিন যখন দিনের আলো ফুটলো তখন পৃথিবীটা আবার ধীর স্থির শান্ত। কিন্তু রাতভর ঝড়ের তাণ্ডব ছেড়ে গেছে তার সাক্ষ্য। বড়বড় গাছ, বাড়ির দেয়াল , পাঁচিল , ইলেকট্রিক পোল উল্টে পড়ে আছে এদিক ওদিক। রাস্তায় জমা জল। পুরো শহরটা যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে একটি রাতে। নিজেদের ব্যস্ততা আর অসহায়তায় পাড়া প্রতিবেশী কেউই লক্ষ্য করলো না ‘দত্ত ভিলা’ র মনোরমা দেবী সেদিন সকালে একবারও তার বাড়ির বারান্দা অথবা সামনের বাগানটিতে এসে দাঁড়ালেন না !
দিন গড়িয়ে গেল। এদিকে সারাদিন বারবার ফোন করে মা কে একটিবার ও যোগাযোগ করতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠলো মনোরমার দুই পুত্র। অবশেষে সন্ধ্যেবেলা পাশের বাড়ির সরকার বাবুদের ফোনে পেয়ে অনুরোধ জানালো তাদের মা কেমন আছে একটু গিয়ে দেখতে। সরকার মশাই দত্ত ভিলায় এসে অনেকবার কলিং বেল বাজালেন। কিন্তু মনোরমা বৌদি দরজা খুললেন না। একটু দুশ্চিন্তায় তিনি আশেপাশের বাড়ির আরো কিছু লোককে ডাকলেন। অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও যখন কেউ দরজা খুললো না তখন সবাই বেশ শঙ্কিত হলেন। পুলিশ এলো। দরজা ভেঙে দেখা গেল ঠাকুরঘরের মাটিতে শায়িত মনোরমা দেবীর প্রাণহীন দেহ। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তিনি। তার মুখে লেগে আছে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি। আর অবাক কান্ড , ঠিক তার পাশেই পড়ে আছে একটি তানপুরা। শুধু একথাটি কেউ জানতে পারল না সেদিন ওই তানপুরায় শেষবারের মতো বেজেছিল –
“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার ,পরানসখা বন্ধু হে আমার॥“
সমাপ্ত
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment