তুমি আসলে বলে…………
জীবন্ত কোনো মানুষই এমন দিন আগে দেখেনি ৷ বাতাসে বসন্ত তবু বাইরে বেরোনো বারোন ৷কারণ করোনা ৷গুটিকয়েক মানুষ (যেমন ল্যারি ব্রিলিয়ান্ট, বিল্ গেট্স)ছাড়া কেউই আগে,এমনকি মাস কয়েক আগেও, ধারনা করতে পারেনি যে আজকের দিনে নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্রের থেকেও ভয়ন্কর হতে পারে কিছু ভাইরাস ৷ মাত্র তিন-চার মাসের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাণ হারালো, আরও বহু লক্ষ আক্রান্ত, তার থেকেও বড় কথা এর শেষ কোথায় বা কবে কেউ জানে না ৷ কলেজে স্ট্যাটিসটিক্স-এর অধ্যাপক বলেছিলেন When one dies, it is a tragedy. When a million die, it is a statistic। করোনার দৌলতে আজ তার আক্ষরিক প্রমাণ পাওয়া গেল ৷ মুড়ি মুড়কির মত মানুষ মারা যাচ্ছে বা আক্রান্ত হচ্ছে ৷ যারা কাছের মানুষ হারাচ্ছে তারা ছাড়া, সবার কাছেই এগুলো শুধুই সংখ্যা ৷ আর প্রকাশিত সংখ্যাগুলো কোনোটাই সঠিক নয়, সঠিক সংখ্যা প্রকাশে বাস্তবিক সমস্যা যেমন রাজনৈতিক কারণও তেমন ৷ তবে আসল সংখ্যাটা অনেক বেশী হওয়াটাই স্বাভাবিক ৷
কর্মসূত্রে নিউ জার্সিতে থাকি ৷ একে গার্ডেন স্টেট বলে ৷ চারিদিকে যথেষ্ট সবুজ, জীবিকার প্রচুর সুবিধা তাই ঘনবসতিও প্রচুর ৷স্বাভাবিক ভাবেই বেশ জমজমাট প্রাণবন্ত জায়গা ৷ হঠাৎ করোনার দাপটে সবাই বাড়ীতে বন্দি, অত্যাবশ্যকীয় কিছু দোকানপাঠ ছাড়া সবকিছু বন্ধ ৷ হাইওয়েগুলো সব ফাঁকা৷ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো মানা, আর বেরোলেও মাস্ক এঁটে সন্ধে আট-টার মধ্যে বাড়ী ঢুকতে হবে৷ বাড়ী থেকে কাজ করছি মার্চের মাঝ থেকে৷ জিম বন্ধ, জুম্বা বন্ধ কিন্তু জুম্ (Zoom) খোলা তাই জুম্বা অন্, আড্ডা অন্ ৷ স্থানীয় পরিচিতরা অধিকাংশই প্রত্যেকদিন নিউ জার্সির গভর্নরের করোনা আপডেট ফলো করছে ৷ অনেকে ‘flattening the curve’নিয়ে বেশ বিশ্লেষণও করছে আর ভবিষ্যদ্বানি করার চেষ্টা করছে কবে এই বন্ধন থেকে মুক্তি পাব ৷মৃত্যুর পারদ বেড়েই চলেছে,এর মধ্যে চেনা-জানা কয়েক জনের আক্রান্ত হবার বা মারা যাবার খবর পেলে মৃত্যুর ছেঁকাটা বেশী লাগছে৷ আমার পরিচিত এক পরিবারের সবার করোনা প্রায় সুনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও কারুর পরীক্ষা করা যায়নি, কারণ টেষ্ট কিট্ যোগান সীমিত ৷ অবশ্য আশার কথা সাপ্লাই বাড়ছে ৷ তবে সত্যি বলতে কি কাল আমার করোনা হলে চিকিৎসা হবে কি না তা জানি না ৷ তাই যতটা সম্ভব সতর্ক ভাবে থাকছি ৷ স্বাভাবিকভাবেই হাজার হাজার মাইল দূরে কলকাতায় বাড়ীর লোকজন খুব চিন্তিত ৷ অবশ্য বাড়ীর সবাই কেমন আছে সেটাও সমান চিন্তার ৷ তবে এই অতিমারীর সময়ে ঘরোয়া কাজের পরে বাড়তি যে অনেকটা সময় পাচ্ছি সেটা বই পড়ে, TED শুনে, গান গেয়ে, ফিল্ম্ দেখে, একটু লেখালিখি করে, সামান্য ফান্ড রেইজিং-র কাজ করে বেশ কাটছে ৷ গৃহবন্দির বদলে আমার তো বেশ মুক্তই লাগছে ৷
সারা আমেরিকার ছবিটা নিউজার্সি বা নিউ ইর্য়কের মত ভয়াবহ না হলেও অনেকটাই এক ৷ লকডাউন, মাস্ক্-পরা মানুষ, social distancing এটাই তো এখন পরিচিত ছবি ৷ এমনকি মানুষের মনে যে ভয় বা যেসব প্রশ্ন তাও এক ৷ শুধু আমেরিকা কেন করোনা যেন সারা পৃথিবীতে একই ছবি এঁকে দিয়েছে, এমন সাম্যবাদ অতুলনীয়৷ তবে জীবন বনাম জীবিকার দন্ধ দিনে দিনে মরিয়া হয়ে উঠছে ৷ তাই আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় কিছু শহর, কাউন্টি খুলছে৷ হা রে রে রে করে অনেকেই বেরুবে তবে এতে করোনা আক্রান্তের বা মৃত্যুর সংখ্যা আবার ঊর্ধমুখী হলে সেটাই ভয়ের৷
করোনার কবলে যখন পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ রহস্যময়ভাবে উধাও হচ্ছে আমার কিছু আশঙ্কা, আশাহীনতা আর আশার কথা জানাই –
যখন প্রায় প্রতেকদিন নতুন টেকনলজির বিষ্ফোরন হচ্ছিল, সারা পৃথিবী হাতের মুঠোয় মনে হত, কোথা থেকে এক ক্ষদ্রাতি ক্ষুদ্র ভাইরাস এসে এক থাপ্পড়ে সব্বাইকে বুঝিয়ে দিল আজও আমরা সবাই কত অসহায়! আমেরিকার কথাই ধরা যাক – আমেরিকা আজও পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ ৷ এখানকার পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য পরিষেবা বিশ্বের প্রথমসারির মধ্যে ধরা যায় ৷ সেই দেশে এই মারণ রোগ এমন মর্মান্তিক হলে আমি ভাবি সেই সব দেশের কি হবে যেখানের জনবসতির ঘনত্ব অনেক বেশী, পরিকাঠামো সীমিত বা সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা অনুন্নত ৷ করোনার করুনা বা মমতা জ্ঞান তো নেই, দেশের বেড়া টপকাতে তার ভিসা লাগে না ৷ তবে নিউ ইয়র্কের এক জার্নালিস্টের করোনা হলে সে এক মস্ত বাড়ীতে নিজেকে কোয়ারিনটাইন করতে পারে কিন্তু ধারাভির বস্তিতে বা কলকাতার বাইপাসের ধারে যেখানে খুব ছোট্টো ছোট্টো ঘরে এক একটা পরিবার থাকে তাদের একজনের করোনা হলে কি করে নিজের বাড়ীতে নিজেকে কোয়ারিনটাইন করবে ৷ যে সরকার যাই ব্যাবস্থা করুক না কেন হু হু করে রোগ ছড়িয়ে পড়লে পর্যাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী পরিকাঠামো বা সেবা যোগান দেওয়া বাস্তবিক অসম্ভব ৷ অবশ্যই সবাই আশা করি সবাই যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করুক যাতে এমন ভয়াবহ দিন দেখতে না হয় আর যত দ্রুত সম্ভব টীকা আবিষ্কার হোক এবং তা সবার কাছে পৌঁছোক৷
আজ সবাই বুঝতে পেরেছি করোনার যুদ্ধে সৈনিকের ভূমিকা নিয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষেরা, front line workers –স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত সবাই, পুলিশ বা সমস্ত মানুষেরা যারা অত্যাবশ্যকীয় সেবার সাথে জড়িত এমনকি জমাদার এবং অন্যান্যরা যাদের জন্য আমরা, অধিকাংশরা্, ঘরের মধ্যে নিরাপদে থাকতে পারছি৷ এমন দিন না এলে হয়ত উপলব্ধি করতাম না আমাদের ভালো থাকা বা নিরাপদ থাকা নির্ভর করে কত অজানা মানুষের অজানা কর্ত্যবের ওপর ৷
ভগবানের থেকে ভাগ্যতে আজ আমি বেশি বিশ্বাসী ৷ যেখানে কোটি কোটি অভাবী মানুষ লক ডাউনে আগামিকাল নিজের পরিবারকে কি খাওয়াবে তা বুঝতে পারছে না সেখানে আমরা, যাদের খাওয়া-পরার কোনো অভাব নেই বা আজও জীবিকা আছে, সত্যিই খুব ভাগ্যবান ৷ তা সত্ত্বেও করোনার জন্য আমরা যারা আমাদের ভীষণ সমস্যার কথা বলছি যেমন গৃহবন্দী হয়ে থাকা বা মনের মত যা-ইচ্ছা খেতে-পরতে-ঘুরতে না পারা বা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করার সমস্যা সেগুলো আসলে আমাদের বহুদিনের বদ আভ্যাসের সাথে বড্ড ঘনিষ্ঠ হয়ে পরার ফল ৷ আমার মা আমাকেই কথা প্রসঙ্গে এক বার বলেছিল স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার জন্য খুব বেশি কিছু লাগে না রে বাবা ৷ আজ সেই কথাটা অনেক বেশি করে উপলব্ধি করতে পারছি আর বুঝছি আমরা অনেকেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ভোগ করাটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলাম ৷
তবে আধিকাংশে্র মত আমিও মনে করি শেষে মানুষেরই জয় হবে, জীবন আবার স্বাভাবিক হবে কয়েক মাস পর, হয়ত এক নতুন রকম স্বাভাবিক জীবন পাবে মানুষ ৷ করোনার দাগ এতটাই দগদগে যে ইতিহাস চিহ্নিত হবে প্রি- এবং পোস্ট্-করোনা যুগ হিসেবে ৷ করোনা কতো মানুষের মধ্যে কতটা স্থায়ী পরিবর্তন আনবে তা ভবিষ্যত বলবে কিন্তু সময় এসেছে সংযত হবার, নিজের গণ্ডী সমন্ধে সচেতন হবার আর আরও বেশী মানবিক হবার ৷
সুমন কুমার চন্দ্র
(লেখকঃ ম্যানেজমে্ন্ট কনসালট্যান্ট , আমেরিকার নিউ জার্সির বাসিন্দা)
হয়ত আবার একদিন কোথাও ঘুরতে যাব
সবাই গৃহবন্দী
প্রকৃতি আজও প্রাণবন্ত – যেন একটু বেশীই খুশী
জনশূন্য রাস্তা তবে অত্যাবশ্যকীয় সেবা চালু
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment