এয়ারপোর্ট
সীমা-ব্যানার্জ্জী-রায়
এয়ারপোর্ট! মানেই হল – “যাওয়া -আসারই এই কি খেলা!”
এই কথাটার মধ্যে যেন একটা বিষাদ আর আনন্দ-এর ছোঁয়া লেগে থাকে। আর এই দু-এরই পরশ মেখে থাকেন সারা পৃথিবীর মানুষ। আমি তুমি আমরা সকলেই।
ঠিক এইরকম লোপা দেবীর আজকাল এই এয়ারপোর্ট নামের ওপরে একটা ফ্রাস্ট্রেশন এসে গেছে। নামটা শুনলেই একটা মাইল্ড স্ট্রোক-এর মতন হয়। অথচ আগে কি ভালই না লাগত। প্রায়-ই যখন এখানে ওখানে স্বামীর সাথে যেতে হত। ছাব্বিশ বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন ওনারা। কলকাতায় ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে একটা ২ রুম ফ্ল্যাট কিনেছেন। বিদেশেই আছে দুই ছেলে আর তিন মেয়ে। তারা পুরোপুরি সংসারী। ওখানে এত বেশী একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে দেশে ফিরে আসাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন। দেশে তবু কিছু লোকজনের যাওয়া আসা থাকে। তা ছাড়াও বাড়িতে কাজের মেয়ে বা লোক তো থাকেই। ছেলে-মেয়েদের ফোনের আশায় আগে বসে থাকতেন। এখন সার বুঝে নিয়েছেন যে, তাদের মর্জ্জিমতো তাদের কুশলাদি মা বাবাকে জানাবে।
আজকাল তিনি এয়ারপোর্টে যান প্রধানতঃ দুটি কারণে। ছেলে মেয়েরা আসে। আবার তারা চলে যায়। যেদিন আসে সেদিন হার্টের কথা ভুলে যান দুজনেই। স্বামীর গায়েও যেন যৌবন ফিরে আসে। কেউ দেখলে বলবে না সেদিন যে আট বছর আগে তার শরীরের অর্ধেকটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। দুজনে মিলে এটা ওটা করেন। আর ছেলে মেয়েরা ছোটবেলায় কে কি পছন্দ করত তা তৈরী করতে শুরু করেন লোপাদেবী। বাড়িকে সাজিয়ে গুজিয়ে ধোপদুরস্ত করে ফেলেন।
বড় ছেলে চুকচুকে ঘিয়ে ভাজা সুজির বরফি, মুচমুচে ডালের কচুড়ি আর আলু পেঁয়াজ চচ্চড়ি খেতে খুব ভালবাসে। ছোটছেলের মায়ের হাতের তৈরী সাদা চমচম আবার ভীষণ প্রিয় ছিল। এই বয়সেই কোলেস্ট্রলের ভয় ঢুকে গেছে। এই সব মিষ্টি জাতীয় খাবার দাবার এ্যভোয়েড করে আজকাল। বৌমা নামকরা কলেজ ‘জন হপকিন্সের’ নার্সিং-এ স্নাতোকোত্তর। তাই চিনির উপর তার কড়া চোখ। মেয়েরাও আজকাল সব কিছুতেই ফ্যাট দেখে। ভাত, আলু, মিষ্টি সব বাদ। স্যালাড, বয়েল্ড, স্যুপ এই সব খেতেই অভ্যস্ত তারা। তাও তো মায়ের মন,এ কদিন খেলে কিছু হবে না ভেবে সারাদিন রান্নাঘরে থাকেন।
হার্টের রোগীরা হয়ত বেশীক্ষণ আগুনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। মাথা ঘুরে যায়। বাড়ির কাজের লোকগুলোকে দিয়ে করানোতে তিনি মোটেই রাজী নন। ওদের তৃপ্তিমাখা মুখগুলো দেখলেই এতদিনের বুকের চাপা হাহাকার নিমেষে উধাও হয়ে যাবে। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী তিনি।
ছোট মেয়ের প্রিয় জিনিস চিংড়ি ভর্ত্তা। অনেক করে সড়ষে, পোস্ত, পেঁয়াজ, লবণ, ঝাল আর সড়ষের তেল মাখানো ভর্ত্তা। যত ঝাল ততই তার পছন্দ। কাঁচা লংকা আর কাঁচা পেঁয়াজ নাকি ফ্যাট বাড়তে দেয় না আর ডায়বেটিসকেও কাছে ঘেঁষতে দেয় না। সে আবার ফিজিক্যাল হেলথ নিয়ে পড়াশুনা করেছে।
ভাজা মরিচ আর তেল মেশানো ছোলার চটপটি আবার মেজ মেয়ের প্রিয় জিনিস। ভাজা ছোলা আজকাল আমেরিকানরাও খাচ্ছে। এই ছোলা ভাজা নাকি শরীরের হাড় রক্ষার কাজ করে ভালো। কথায় কথায় জানিয়ে রেখেছে মাকে আসবার আগেই।
বড় মেয়ে আবার মায়ের হাতের কাঁচকলা আর এঁচোড়ের চপ খেতে খুব ভালবাসে। একটা হাত একটু অচল হয়ে পড়েছে। তাতে কি? সেই হাতেই তৈ্রী করছেন সব খাবার। আহা ওদের হাসিমুখগুলো দেখলেও তো মনে অনেক শান্তি থাকবে কদিন। তিনি যে মা!
মেয়েরা, ছেলেরা বৌরা এখানে আসলেও বাচ্চাদের রেখে বাইরে বাইরেই থাকে সারাটাদিন। তাদের শপিং আর যাবতীয় কাজ সারে। রাত টুকুনি হয়ত এক সাথে খাওয়া দাওয়া হয়। আবার এর মধ্যে যে যার শ্বশুরবাড়িতেও তিন চারদিন থেকে আসে। আসে তো মাত্র একুশ দিনের জন্য।
বারান্দায় বসে বসে আবার সেই স্মৃ্তি রোমন্থন। হঠাৎ তিনি চলে গেছেন নিজের প্রয়াত মায়ের কাছে। কষ্ট করে মা ও তো এমনি সব সখের জিনিসগুলো বানিয়ে রাখতেন বিদেশে থাকা ছোটমেয়ের জন্য। পুরানো ধ্যান ধারণা আঁকড়েই কেটে যাবে বাকি জীবন। নতুন করে আর কিছু ভাবতে পারেন না তিনি। মায়েরা বেঁচে থাকতে তাঁদের কষ্টের কথা আমরা ছেলে মেয়েরা কেউ ভাবি না। মনে মনে বিড় বিড় করে বলে উঠলেন। আজ নিজে মা হয়ে সব কিছু বুঝতে পারছেন, দেখতে পারছেন চোখের সামনে। ছেলে মেয়েরা ঘরে ঢুকতেই যেন চলে আসে “এবার বিদায় দাও” নামের যাওয়ার দিনটা। আসার দিনটা চোখের পলকে আসে না, শুধু যাবার দিনটাই আসে। ওরা বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দুয়ারে প্রস্তত হয় বিদায় নেবার জন্য। এয়ারপোর্টের বারান্দায় গিয়ে বাক্সবোঝাই গাড়িটা খালি হয়ে যায়। গাড়ী হাল্কা হয় কিন্তু মনটা হাল্কা হয় না। “ডুবে যায় হাসি আঁখিজলে” ।
মালপত্র চেক-ইন করার পর ওদের সঙ্গে ডিপার্চার লাউঞ্চে যান। দুবছর, তিন বছরের নাতি নাতনি সমস্ত লাউঞ্চ দাপিয়ে বেড়ায়। কারুর গায়ে ধাক্কা লাগতে পারে সেদিকে হুঁশ নেই। মা বাবা পেছন পেছন ছোটে। ঠিক আমাদের মতন। এখন আমরা ছুটতে পারি না, শুধু এই মন, অন্ধ নির্বাক মন, কেবলি ছুটে বেড়ায়। হাঁতড়ে বেড়ায় স্মৃতির বাক্স।
কিছুক্ষণ পর ওরা সিকিউরিটি চেকের দরজা পার হয়ে হাত নাড়তে নাড়তে ভেতরে ঢুকে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন দুজনে। একটা ক্লান্তি আর শূন্যতা ঘিরে থাকে দেহে আর মনে তাদের।
জীবনের এইভাবে এক একটা অধ্যায় যেন শেষ হয়ে যায়। এই শেষ আর কোনদিন পূর্ণ হয় না। শূণ্যই থেকে যাবে অনন্তকাল। প্লেন মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে যায় সবাইকে নিয়ে। একটা পূর্ণ দীর্ঘশ্বাস হুইসিলের মত ওনাদের বাড়ি ফেরার ইঙ্গিত জানায়। এয়ারপোর্ট ছেড়ে আসেন তারা। খালি গাড়িতে দুজন নির্ব্বাক পুতুল বাড়ি ফিরে আসেন। মনকে সান্ত্বনা দেন, বিদেশে থাকতে ওরা আসত মাত্র লং উইকেন্ডে। থাকত দু দিন। তাও তো এখানে কিছুদিন থেকে গেল।
তাঁর মা-এর শিক্ষা মনে পড়ে, বলতেন ‘সাফল্য, আশাভঙ্গ,জয় পরাজয় নিয়েই প্রতিদিনের মোকাবিলা। এতে ধৈর্য্য হারাতে নেই। জীবনে আনন্দ পাওয়ার অনেক উপকরণ থাকে এই পৃথিবীতে। তুচ্ছ ঘটনাগুলো উপেক্ষা করতে হয়। যে কাজ আনন্দ দেয়, সেই কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হয়। অথচ এই সেদিনও বাবা মাকে, শ্বশুর শাশুড়িকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন এই এয়ারপোর্টে। ফেরার সময় বুকে জড়িয়ে থাকতেন কিছু সময়। বিদায় নেবার সময় মা-দের মুখে আঁচলের খুঁটি। বাবাদের এড়িয়ে যাওয়া আর নয়ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দুটি চোখ।
তাঁদের ছেলে মেয়েরাও এখন ঠিক তেমনি এদিক ওদিক না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। হয়ত ওরাও ভাবে একদিন আমাদের স্থান ওদেরও নিতে হবে। বিদায়কে বড্ড ভয় পান আজকাল। এই বিদায়ই সব মা বাবাদের নিয়তি। কেউ থাকার জন্য আসে না, ফিরে যাবার জন্য আসে।
পুরনো ঘটনাগুলো লতানে গোলাপের মতো জাপটে ধরে ছেলে-মেয়েরা চলে যাবার পর পরই। কি তাড়াতাড়ি বছর বছর ক্যালেন্ডার পাল্টাতে হয়। এরই মধ্যে অনেকগুলো বছর, কয়েকটি যুগ চলে গেছে। এইভাবেই একদিন তাঁর মা বাবা ছাড়াই বাড়ির লোকজনেরা এসেছিল এয়ারপোর্টে। একদিন তাঁরাও পারবেন না তাঁদের ছেলে মেয়েদের আনতে বা বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে । অবশ্য অনেক আধুনিক হয়ে গেছে আজকের মানুষ। আধুনিক হয় না বোধহয় শুধু মায়েরা, বাবারা। বিদায়বেলায় তাঁরা সেই একইভাবে এয়ারপোর্টে গিয়ে নিরিবিলি কোনায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন আজও। চোখের জল চোখেই শুখিয়ে যায়। আবার অপেক্ষা করার দিন গুণতে শুরু করেন……
“শুধু যাওয়া-আসা,শুধু স্রোতে ভাসা…”
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment