আত্মা মৃত্যুহীন
কুমুদ রঞ্জন রায়
আপনারা অনেকেই হয়তো স্বামী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নাম শুনে থাকবেন ৷ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের লীলাপার্শ্বদ অদ্বৈত আচার্যের বংশে নদীয়া জেলার অন্তর্গত শান্তিপুরে ১৮৪১ খৃষ্টাব্দে ২রা আগষ্ট তার জন্ম হয়েছিল ৷ পিতার নাম ছিল আনন্দচন্দ্র গোস্বামী এবং মাতার নাম স্বর্ণময়ী দেবী ৷ পিতামাতা দুজনেই ছিলেন বৈষ্ণবীয় দৈন্যের প্রতিমূর্তি পরম ভাগবত ৷ বিজয়কৃষ্ণ প্রথম যৌবনে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের একজন প্রচারক ছিলেন ৷ পরবর্তি জীবনে তিনি একজন হিন্দু সাধক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন ৷ এই ঘটনাটি বিজয়কৃষ্ণের বাল্যকালের ঘটনা ৷
বিজয়ের বয়স তখন পাঁচ বছর ৷ পাশের গ্রাম শিকারপুরের পাঠশালায় ভর্তি হয়েছে বিজয় ৷ একটি মাদুর বগলে করে একটি বাঁশবাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে রোজ স্কুলে যায় ৷ বন্ধুদের পাশাপাশি বসে লেখাপড়া শেখে, খেলাধুলা করে ৷ বেশ কাটছিল সময় ৷
হঠাৎ কলেরা শুরু হয়েছে শান্তিপুর-শিকারপুর এলাকায় ৷ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সর মারা যাচ্ছে ৷ কয়েকদিন ধরে বিজয়ের তিন বন্ধু – অমল, বঙ্কিম, সমীর স্কুলে আসছে না ৷ পাঠশালার গুরু ভগবান সরকার, তাকে জিজ্ঞেস করল বিজয় – পন্ডিতমশায়, ওরা আসচে না কেন ?
ওরা মারা গেছে – বললেন পন্ডিত মশাই ৷
ওরা আর স্কুলে আসবে না ?
না আর আসবে না, ওরা আর নেই ৷
বেদনার চেয়ে বিষ্ময় বেশী বিজয়ের ৷ যে মাদুরে তারা বসত, সে মাদুর আছে ; যে বই তারা পড়ত, সে বই আছে ; যে জিনিষগুলো নিয়ে তারা খেলাধুলো করত, সে জিনিষগুলো আছে ; অথচ ওরা নেই ৷ এই আছে, আবার এই নেই – এটা হতে পারে ? একবার যা থাকে তা আবার থাকে না ? মহাচিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছে বিজয়ের শিশুমন ৷ ভারাক্রান্ত হ্রদয়ে বাড়ী ফিরে আসে ৷ বাড়ীতে এসেও সেই একই চিন্তা – তোরা কোথায় গেলি ?
পরেরদিন আবার বেদনা ভারাক্রান্ত হ্রদয়ে বিজয় রওনা হয় স্কুলের পথে ৷ চলেছে সেই বাঁশবাগানের ভিতর দিয়ে আর ভাবছে – তোরা সব কোথায় গেলি ? হঠাৎ সব
বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল – বিজয়, আমরা আছি, আমরা আছি ৷
তোরা আছিস, তবে তোদের দেখতে পাচ্ছি না কেন ?
আমাদের যে শরীর নেই ৷
একছুটে পাঠশালায় চলে এল বিজয় ৷ এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ভগবান সরকারকে – পন্ডিতমশাই, অমল, বঙ্কিম, সমীর ওরা ঐ বাঁশবাগানে আছে ৷ আমার সঙ্গে ওরা কথা বলেছে ৷ কিন্তু পন্ডিতমশাই আমল দেয় না বিজয়ের কথায় ৷ কিন্তু জেদ ধরলো বিজয়, বললো আপনি একবার চলুন আমার সঙ্গে, শুনতে পাবেন – ওরা কথা কইছে ৷
তুই ঠিক বলছিস, ওদের কথা তুই শোনাতে পারবি – গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন পন্ডিতমশাই ৷
হ্যাঁ পন্ডিতমশাই, নিশ্চয়ই পারব – বললো বিজয় ৷
বেশ, চল তা’হলে ৷
পন্ডিতমশাইকে নিয়ে বিজয় এল সেই বাঁশবাগানে ৷ কিন্তু কোথায় সেই ছেলেরা, কোথায় তাদের কচি গলার কন্ঠস্বর ? বিজয় চিৎকার করে বলল – ওরে তোরা কোথায় গেলি, তোরা একটু কথা ক ৷ পন্ডিতমশাইকে নিয়ে এসেছি, পন্ডিতমশাই তোদের কথা শুনতে চায় ৷ কিন্তু চারিদিকে নিঃশব্দ মৌনতা ৷
রেগে গেলেন পন্ডিতমশাই, বললেন – যতসব ফাজলামো ৷ পন্ডিতমশাই হাত তুললেন বিজয়কে এক থাপ্পর মারার জন্য ৷ হঠাৎ ছেলেরা একসঙ্গে কচিকন্ঠে কলধ্বনি করে উঠল – পন্ডিতমশাই, বিজয়কে মারবেন না, এইতো আমরা এখানে আছি ৷ পন্ডিতমশাইয়ে উদ্যত হস্ত অসাড় হয়ে গেল ৷ ব্যাকুল হয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগলেন ভগবান সরকার, বললেন – কই তোরা ?
চারিদিক থেকে কলধ্বনি হতে লাগলো – এইতো আমরা এখানে, আমরা এখানে, আমরা এখানে ৷ তারপর সে কলধ্বনি দিগন্তে মিলিয়ে গেল ৷
বিজয়কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ভগবান সরকার, ভাবলেন – কে কার গুরু ৷ যে দেখায় আর শেখায়, সেই তো দ্রষ্টা, সেই তো স্রেষ্টা, সেইই তো আচার্য্ ৷
তথ্যসুত্র: ১) শঙ্করনাথ রায়ের – ভারতের সাধক
২) অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের – পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ
Comments »
No comments yet.
RSS feed for comments on this post. TrackBack URL
Leave a comment